কখনো ভাবিনি যে এরকম কোনো পরিস্থিতিতে বসে লেখাটি লিখতে হবে। ২০২১ সালে নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ড ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলাদেশের হিজড়া জনগোষ্ঠীর ওপরে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছি। এদেশের লিঙ্গ বৈচিত্র্যময় মানুষের সঙ্গে আমার কাজ করার অভিজ্ঞতা ১২ বছর। এ বিষয়ে বই লিখব লিখব করে ভেবেই গিয়েছি কিন্তু লেখা আর হয়ে ওঠেনি। দিনদুয়েক আগে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জানতে পারি যে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাবেক খন্ডকালীন শিক্ষক, সপ্তম শ্রেণির বইয়ের দুটি পাতা টেনে ছিঁড়ে ফেলেছেন এবং ট্রান্সজেন্ডারদের ‘সমকামী’ আখ্যা দিয়েছেন। তিনি সবাইকে সপ্তম শ্রেণির সমাজবিজ্ঞানের বই ক্রয় করে ‘শরিফার গল্প’ এই দুই পাতা ছিঁড়ে ফেলতে আহ্বান জানিয়েছেন। এখানেই সীমিত না, তার সঙ্গে জড়িত আছে বিভেদ ও বিভাজনের প্রচেষ্টা এবং বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেওয়ার উসকানি।
সাধারণত, যখন ব্যক্তির যৌনাঙ্গ বিবেচনা করে তাকে নারী বা পুরুষ হিসেবে শনাক্ত করা হয়, তখন সেটিকে বলা হয় ব্যক্তির সেক্স আইডেন্টিটি। যেমনটি আপনি পাসপোর্ট অথবা ন্যাশনাল আইডেন্টিটি কার্ডে লিখে থাকেন। আর ব্যক্তির এই সেক্স আইডেন্টিটির যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বহিঃপ্রকাশের নির্মাণ সেটিকে আমরা জেন্ডার বলি। সংকট হচ্ছে, বাংলাতে সেক্স এবং জেন্ডার উভয়ের অনুবাদ ‘লিঙ্গ’। এখানে একটি ভাষাগত বোঝাপড়ার জটিলতা তৈরি হয়। অর্থাৎ এখানে সংকট রয়েছে, যার ফলে লিঙ্গ পরিচয় বললেই আপনার মাথায় আসতে পারে যে, তার কি পেনিস আছে নাকি তার ভ্যাজাইনা আছে? নাকি তার জেনিটাল আইডেন্টিটি নির্ধারণ করা যাচ্ছে না। অর্থাৎ মোটা দাগে আমাদের মাথার মধ্যে কাজ করে নারী, পুরুষ ও আন্তঃলিঙ্গ বা ইন্টারসেক্স-এর ধারণা। এটি তো গেল কেবলই জৈবিক ভিন্নতার আলাপ কিন্তু আপনি যখন প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় লিঙ্গের আলাপ করেন, তখন আপনি এবং অবচেতনভাবে লিঙ্গীয় সম্পর্কের একটি হায়ারার্কিক্যাল সম্পর্ক স্থাপন করেন। যেখানে আপনি সচেতনভাবে পুরুষকে ‘প্রথম লিঙ্গ’, নারীকে ‘দ্বিতীয় লিঙ্গ’ এবং অন্য অপরাপর লিঙ্গীয় পরিচিতির মানুষকে ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ হিসেবে শনাক্ত করেন।
আমাদের অঞ্চলের যৌন বিষয়ক সবচেয়ে আলোচিত যে গ্রন্থ কামসূত্রে উল্লেখ করা হয়, মানুষের যৌনতা তিন প্রকৃতির পুরুষ প্রকৃতি, নারী প্রকৃতি ও তৃতীয় প্রকৃতি। কোন অজানা ও দুর্বোধ্যতার কারণে, এই তৃতীয় প্রকৃতির যৌনপ্রবৃত্তি আমাদের কাগজে-কলমে ও ভাষায় প্রকাশ পায় ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ হিসেবে। ভাষাগত জটিলতা ও হায়রার্কিক্যাল সামাজিক ক্ষমতা সম্পর্কের পাটাতনে এই তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে পরিচিতি পায় আমাদের দেশের হিজড়া জনগোষ্ঠী।
ট্রান্সজেন্ডার একটি পশ্চিমা আমব্রেলা টার্ম, যার বাংলা রূপান্তরিত জনগোষ্ঠী। সহজ করে বললে আপনি যদি আপনার জন্মগত বৈশিষ্ট্য বা আইডেন্টিটির বিপরীতে অন্য কোনো ধরনের আইডেন্টিটিকে ধারণ করতে চান তবে আপনি ট্রান্স আইডেন্টিটির মধ্যে নিজেকে শনাক্ত করতে পারেন। ট্রান্সজেন্ডার-এর মধ্যে দুটি ভাগ আছে। ট্রান্স ম্যান ও ট্রান্স ওমেন। এক্ষেত্রে ধরুন, আপনি এক্স এক্স ক্রোমোজোম নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছেন এবং আপনি জৈবিকভাবে একজন নারী। কিন্তু আপনি আপনার পিউবার্টি চলাকালীন আবিষ্কার করলেন আপনি একজন পুরুষ। এক্ষেত্রে হতে পারে বয়ঃসন্ধিকালে আপনার মাসিক হওয়ার কথা, কিন্তু সেটি হরমোনাল ব্যালেন্সের কোনো কারণে হয়নি। অথবা আপনি সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত নারীত্বকে গ্রহণে অনাগ্রহী। এমনকি আপনার শারীরিক পরিবর্তন আপনার মানসিক দ্বন্দ্বের মধ্যে প্রতিফলিত হয়। আপনি নিজেকে একজন পুরুষ হিসেবে পরিচিতি দানে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। অন্যদিকে ট্রান্স ওমেন, শারীরিকভাবে পুরুষ হিসেবে জন্মগ্রহণ করলেও তার যৌনাঙ্গ ‘পুরুষালিভাবে’ ক্রিয়াশীল নাও হতে পারে। যৌনাঙ্গের গঠন কাঠামোর স্বাভাবিক বৃদ্ধি নাও হতে পারে। আবার যৌনাঙ্গ পুরোপুরি স্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার পরও পুরুষ হিসেবে নিজ শরীর অথবা মনকে নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দিতে পারে। এরকম অবস্থায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত নারীর শরীরী অবয়বে আত্মপ্রকাশের সচেষ্ট হয়ে ট্রান্স ওমেন হিসেবে তিনি আবির্ভূত হন। বলা বাহুল্য, এই রূপান্তরের প্রক্রিয়াটি শারীরিক এবং মানসিক। এদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা হরমোন গ্রহণের মধ্য দিয়ে শারীরিক ট্রান্সফরমেশনের মধ্য দিয়ে যান অথবা সেক্সচুয়াল রি-অ্যাসাইনমেন্ট সার্জারি করেন। উল্লেখ্য, এই সেক্সচুয়াল রি-অ্যাসাইনমেন্ট সার্জারি একই সঙ্গে সময়সাপেক্ষ এবং ব্যয়বহুল। পাশাপাশি তাদের হরমোনাল থেরাপির প্রক্রিয়াটিও সময়সাপেক্ষ ও জটিল।
হিজড়া জনগোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের বৈচিত্র্য। এর মধ্যে আছে জানকা, জানানা, ছিবড়ি, ভাবরাজের হিজড়া, কোতিসহ আরও নানা ধরনের বৈচিত্র্য। হিজড়া সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত রয়েছে নানা ধরনের আচার। হিজড়া লিঙ্গ বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর মধ্যে রূপান্তরকামীর সংখ্যাও কম নয়। খুব স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন ধরনের সার্জিক্যাল প্রসেসের মধ্য দিয়ে, হরমোন গ্রহণের মধ্য দিয়ে রূপান্তরিত নারী তথা ছিবড়িতে পরিণত হয়। এই প্রক্রিয়াতে যুক্ত রয়েছে কিছু নির্দিষ্ট চিকিৎসক। এই চিকিৎসা গ্রহণ প্রক্রিয়াটি ভীষণভাবে গোপনীয়। এমনকি যারা এই চিকিৎসা প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত তাদের প্রয়াশই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, মিডিয়াতে ও আইনের চোখে অপরাধী হিসেবে গণ্য করা হয়। অথচ এই চিকিৎসা গ্রহণ প্রক্রিয়াটি লিঙ্গ বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর জন্য তথা হিজড়া জনগোষ্ঠীর ও ট্রান্সজেন্ডারদের জন্য ভীষণ স্বাভাবিক একটি বিষয়। যেমন উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ইরানে রূপান্তরকামী জনগোষ্ঠীর লিঙ্গ পরিবর্তনের বিষয়টি রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত এবং রাষ্ট্রীয় খরচে তা বহন করা হয়।
ঐতিহাসিকভাবে এই অঞ্চলের হিজড়া জনগোষ্ঠীর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে লক্ষ করা যায়, এই অঞ্চলের লিঙ্গ বৈচিত্র্যময় মানুষের উপস্থিতির ও সেক্সচুয়াল ফ্লুয়েডিটি বা যৌন তারল্যতার ধারণা সামাজিকভাবে বৈধ। সনাতন ধর্মালম্বীদের মহাভারত, রামায়ণ ও মনুসংস্কৃতিতে উল্লেখযোগ্যভাবে হিজড়া, শিখন্ডি লিঙ্গ বৈচিত্র্যময় মানুষের উপস্থিতি সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়। মুঘল শাসনকালে, সম্রাট বাবরের সময় ‘নাজির’ হিসেবে রাজদরবারে ও পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহের কাজে এই জনগোষ্ঠীর মানুষেরা নিয়োজিত ছিল। তাছাড়া তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থায় এলিট জনগোষ্ঠীর হয়ে বিভিন্ন ধরনের কাজে নিযুক্ত ছিল এই লিঙ্গ বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর মানুষেরা। কিন্তু ব্রিটিশ শাসনকালে, তৎকালীন ব্রিটেনের লিঙ্গ বৈচিত্র্যের ধারণা ছিল ভীষণভাবে বাইনারি, তাই ব্রিটিশ অনুশাসনকালে এই অঞ্চলের লিঙ্গ বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর ওপর আরোপণ করা হয় ব্রিটিশ ক্রিমিনাল ট্রাইব অ্যাক্ট ১৮৭১। এর ২৪, ২৬ ও ২৯ ধারা অনুসারে বলা হয়, যদি কোনো পুরুষ ‘মেয়েলি আচরণ’ করে, মেয়েদের মতো পোশাক পরিধান করে, প্রকাশ্যে মেয়েদের পোশাক পরে নাচ, গান করে তবে তাকে ক্রিমিনাল হিসেবে গণ্য করা হবে। এরই মধ্য দিয়ে এই অঞ্চলের লিঙ্গ বৈচিত্র্যময় মানুষ জনগোষ্ঠীকে ‘সামাজিক ক্যাটাগরি’ থেকে পরিণত করা হয় ‘লিগ্যাল ক্যাটাগরিতে’ যেখানে তাদের সংজ্ঞায়িত করা হয় অপহরণকারী তথা ক্রিমিনাল হিসেবে। বাধ্যতামূলকভাবে তাদের রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়ারও আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
এইরূপ ধারাই অব্যাহত থাকে ১৯৪৮ পরবর্তী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানে। তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধান আইয়ুব খানের শাসনামলে, ব্রিটিশ শাসন ব্যবস্থার হেজিমনিক ধারণার সূত্র ধরে তৎকালীন পাকিস্তানের লিঙ্গ বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীকে ট্যাবু বিবেচনা করা হয়, এবং তাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘অবৈধ’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। কিন্তু সে সময় পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থানরত হিজড়া নেতারা, খোজাছাড়া এবং খোজাছাড়াছিস নেতারা তৎকালীন পাকিস্তান প্রধান আইয়ুব খানের বাসার সামনে অবস্থান ধর্মঘট করেন। তারা আইয়ুব খানের মায়ের কাছে আবেদন করেন, যাতে রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের অবৈধ ঘোষণা করা না হয়। তারা এও বলেন, ‘আইয়ুব যখন ছোট ছিল তখন তারা তাদের বাড়িতে এসে আইয়ুব খানকে আশীর্বাদ করার পরিপ্রেক্ষিতেই তিনি পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন।’ তাদের এই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আইয়ুব খানের মা তাকে অনুরোধ করেন সামাজিকভাবে লিঙ্গ বৈচিত্র্যময় এই জনগোষ্ঠীকে যেন অবৈধ ঘোষণা না করা হয়। এই সূত্রে আইয়ুব খান তার নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন। পরবর্তী সময়ে স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৯০-এর দশকে পৃথক বা স্বতন্ত্র স্বীকৃতি প্রদান না করা হলেও বেসরকারি সংস্থাসমূহ ও পশ্চিমা দাতা সংস্থাসমূহের আগ্রহের এইচআইভি ডিসকোর্সে, এই জনগোষ্ঠীকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী’ হিসেবে চিত্রায়ণ করা হয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে এই জনগোষ্ঠী আরও প্রান্তিক হয়ে পড়ে। ২০১৪ পরবর্তী সময়ে, হিজড়া জনগোষ্ঠীকে সামাজিকভাবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান করা হয়।
এবার আসেন প্রশ্ন করা যাক ট্রান্সজেন্ডার কি সমকামী? এই উত্তরটা খুব সাধারণ কমনসেন্স থেকে আপনি পেতে পারেন। সমকামিতার সহজ উত্তর হচ্ছে সম-লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ। এখন আপনি যদি ট্রান্স ম্যান অথবা ট্রান্স ওমেন-এর দিকে তাকান, খেয়াল করবেন, অধিকাংশ সময়ই সে নিজেকে যদি নারীতে রূপান্তরিত করে, সে সেক্সচুয়াল রি-অ্যাসাইনমেন্ট সার্জারি করায়, একটি কৃত্রিম ভ্যাজাইনা ইমপ্লান্টেশন করে এবং যৌন সঙ্গমের জন্য একজন পুরুষ সঙ্গীকে বেছে নেয়। অন্যদিকে সে যদি ট্রান্স ম্যান হয়, সে তার পুরুষ যৌনাঙ্গ অর্থাৎ শিশ্ন এমাসকুলেশন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে রূপান্তরিত করে। তার যৌনতার আকর্ষণ হয় নারীর প্রতি। তাহলে প্রশ্ন করা যেতেই পারে যে কীভাবে এবং কোন প্রক্রিয়ায় এদের সমকামী বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে? কেবল শারীরিক বা জৈবিক বাস্তবতাই কি একমাত্র সত্য? নাকি এর পেছনে লুকায়িত আছে কোনো রাজনৈতিক ও উগ্রবাদী উসকানি?
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যাল