বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) কয়েকজন কর্মকর্তা তাদের ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থকে বৈধ করতে তাদের স্ত্রীদের ব্যবসায়ী বানিয়েছেন বলে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে। সংস্থাটির প্রাথমিক অনুসন্ধানে বিআইডব্লিউটিএর চারজন কর্মকর্তা ও তাদের স্ত্রীর নামে কোটি টাকার সম্পদ অর্জনের তথ্য পাওয়া গেছে। শিগগিরই এসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সম্পদ বিবরণীর নোটিস জারি করা হবে।
জানা গেছে, ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট থেকে বিআইডব্লিউটিএ তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী জরিনা খানম ও অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (মেরিন) আইয়ুব আলীসহ ১৮ কর্মকর্তা ও তাদের স্ত্রীদের বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জন-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন পাঠানো হয় দুদকে। কমিশন অভিযোগটি অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য সংস্থাটির উপপরিচালক মো. মশিউর রহমানকে প্রধান করে একটি টিম গঠন করে। টিমের অন্য সদস্য হলেন সহকারী পরিচালক তাপস ভট্টাচার্য্য। অনুসন্ধান টিম অনুসন্ধান শেষে গত বছরের ডিসেম্বর মাসে কমিশনে প্রতিবেদন দাখিল করে।
দুদকের একজন কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে বিআইডব্লিউটিএর চারজন কর্মকর্তা ও তাদের স্ত্রীর বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাদের বিরুদ্ধে সম্পদ বিবরণীর নোটিস জারি করার অনুমোদন দিতে অনুসন্ধান টিম কমিশনে একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। কমিশন প্রতিবেদন যাচাই-বাছাই শেষে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নির্দেশনা দেবে।
যাদের বিরুদ্ধে সম্পদ বিবরণীর নোটিস জারির অনুমোদন চাওয়া হয়েছে, তারা হলেন পরিচালক রফিকুল ইসলাম ও তার স্ত্রী সাবিহা পারভিন মুন্নী, অবসরপ্রাপ্ত পরিচালক শফিকুল হক ও তার স্ত্রী শামীমা আক্তার, যুগ্ম পরিচালক গুলজার আলী ও তার স্ত্রী সালমা হক এবং উপপরিচালক মো. শহীদ উল্লাহ ও তার স্ত্রী ফাতেমা পারভীন।
পরিচালক রফিকুল ইসলাম ও তার স্ত্রী সাবিহা পারভিন মুন্নী : রফিকুল ইসলাম ১৯৯২ সালে চাকরিতে যোগ দেন। বর্তমানে তিনি নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তার স্ত্রী সাবিহা পারভিন মুন্নী গৃহিণীর পাশাপাশি একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। তার স্ত্রীসহ আরও কয়েকজন মিলে লিজেন্ড-১০ শিপিং লাইন্স কোম্পানির মর্নিং ভয়েজ নামের নৌযানে ২০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন। দুদকের অনুসন্ধানে তাদের ৫ কোটি ৩৬ লাখ ৫০ হাজার ৯৪৯ টাকার সম্পদ অর্জনের তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়। এর মধ্যে ২ কোটি ৩৯ লাখ ৯৬ হাজার ২৬১ টাকার সম্পদ অর্জনের বৈধ কোনো উৎস পাওয়া যায়নি। তারা এ পরিমাণ অর্থ অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জন করেছেন বলে দুদকের কাছে প্রতীয়মান হয়। এ কারণে তাদের বিরুদ্ধে সম্পদ বিবরণীর নোটিস জারির অনুমোদন দিতে কমিশনের কাছে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে রফিকুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, তিনি অভিযোগের বিষয়ে কিছুই জানেন না। এ বিষয়ে পরে কথা বলবেন বলে তিনি জানান।
পরিচালক শফিকুল হক ও তার স্ত্রী শামীমা আক্তার : শফিকুল হক ১৯৮৯ সালে চাকরিতে যোগ দেন। তিনি ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর বিআইডব্লিউটিএর পরিচালক (সচিব) পদ থেকে পিআরএলে যান। তার স্ত্রী একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। তার এক ছেলে চাকরি করেন ও আরেক ছেলে শিক্ষার্থী। ২০১৮ সালে তার স্ত্রীসহ ১২ জন মিলে রোজ ডজন নামের একটি কোম্পানি গঠন করেন। কোম্পানিতে স্ত্রীর ১০০ টাকা মূল্যের ১৫ হাজার শেয়ার অর্থাৎ ১৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ রয়েছে। তাদের সম্পদের পরিমাণ ৪ কোটি ৯৫ লাখ ৩৩ হাজার ২৮৪ টাকা। এর মধ্যে তাদের ৩ কোটি ২১ লাখ ১৯ হাজার ৫৭৪ টাকার বৈধ উৎস পাওয়া গেলেও ১ কোটি ৭৪ লাখ ১৩ হাজার ৭১০ টাকা অর্জনের বৈধ কোনো উৎস পাওয়া যায়নি। তারা এ পরিমাণ অর্থ অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জন করেছেন বলে দুদকের কাছে প্রতীয়মান হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে সম্পদ বিবরণীর নোটিস জারির অনুমোদন দিতে কমিশনে অনুসন্ধান প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে।
যুগ্ম পরিচালক গুলজার আলী ও তার স্ত্রী সালমা হক : গুলজার আলী ১৯৯৪ সালে চাকরিতে যোগ দেন। বর্তমানে তিনি ঢাকা নদী বন্দরের নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা পদে দায়িত্ব পালন করছেন। ২০১৭ সালের ১২ জানুয়ারি তার স্ত্রী সালমা হকসহ ১০ জন মিলে লিজেন্ড-১০ শিপিং লাইন্স (প্রা.) লিমিটেড কোম্পানি চালু করেন, সেখানে তিনি ২০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন। এসব শেয়ার ২০২২ সালের ২০ মার্চ বিক্রির মাধ্যমে হস্তান্তর করে দেন। বর্তমানে তাদের সম্পদের পরিমাণ ২ কোটি ৮৫ লাখ ২৩ হাজার ৪৪৬ টাকা। এর মধ্যে তাদের ৩৭ লাখ ৬২ হাজার ৫২২ টাকা অর্জনের বৈধ কোনো উৎস পাওয়া যায়নি। তারা এ পরিমাণ অর্থ অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জন করেছেন বলে দুদকের কাছে প্রতীয়মান হয়।
উপপরিচালক মো. শহীদ উল্লাহ ও তার স্ত্রী ফাতেমা পারভীন : মো. শহীদুল্লাহ ২০০৫ সালে চাকরিতে যোগ দেন। বর্তমানে তিনি ঢাকা বন্দর ও পরিবহন বিভাগে দায়িত্ব পালন করছেন। ২০১৮ সালের ১১ এপ্রিল তার স্ত্রী ফাতেমা পারভীনসহ ১২ জন মিলে রোজ ডজন নামের একটি কোম্পানি গঠন করেন। কোম্পানিতে ১০০ টাকা মূল্যের ১৫ হাজার শেয়ার অর্থাৎ ১৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন। এসব শেয়ার ২০২০ সালের ৮ অক্টোবর বিক্রির মাধ্যমে হস্তান্তর করেন। এই দম্পতির সম্পদের পরিমাণ ৩ কোটি ১৭ লাখ ৬১ হাজার ৩১১ টাকার। এর মধ্যে ১ কোটি ১১ লাখ ২১ হাজার ৯৮১ টাকা অর্জনের বৈধ কোনো উৎস পাওয়া যায়নি। তারা এ পরিমাণ অর্থ অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জন করেছেন বলে দুদকের কাছে প্রতীয়মান হয়।