নেপালে নির্মাণাধীন ভারতের জিএমআর গ্রুপের একটি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পরিকল্পনা বাতিল করেছে বাংলাদেশ। একই সঙ্গে বাংলাদেশ-ভারতের উদ্যোগে একটি যৌথ বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন নির্মাণের যে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, সেটিও বাস্তবায়ন করা থেকে বাংলাদেশ পিছিয়ে এসেছে বলে বিদ্যুৎ বিভাগের একাধিক সূত্র জানিয়েছে।
জানতে চাইলে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) চেয়ারম্যান মো. রেজাউল করিম দেশ রূপান্তরকে বলেন, যেহেতু বিদ্যুতের বিশেষ ক্ষমতা আইন এখন আর কার্যকর নেই, তাই আপাতত ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হচ্ছে না। একই সঙ্গে বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনটিও এর সঙ্গে সম্পর্কিত। তাই এ লাইন নির্মাণ করে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় করবে না সরকার।
গত শনিবার রাত ১২টা থেকে ভারতের সঞ্চালন লাইন ব্যবহার করে নেপাল থেকে প্রায় ৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করে বাংলাদেশ। প্রাথমিক অবস্থায় পাঁচ বছর মেয়াদি চুক্তি করেছে দেশ দুটি। প্রতিবছর ১৫ জুন থেকে ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাস বাংলাদেশে বিদ্যুৎ রপ্তানি করবে নেপাল। গত বছরের ১৫ নভেম্বর চুক্তি বাস্তবায়নে প্রতীকী হিসেবে এক দিনের জন্য বাংলাদেশে বিদ্যুৎ দিয়েছিল নেপাল। চুক্তি অনুযায়ী প্রতি ইউনিটের দাম ৭ টাকা ৮৭ পয়সা (৬ দশমিক ৪ সেন্ট)।
এরপরই নেপালে নির্মাণাধীন ভারতের জিএমআর গ্রুপের ৯০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ওই ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির কথা ছিল। এজন্য ২০১৯ সালে জিএমআরের সঙ্গে চুক্তি সই করেছিল পিডিবি।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ ও নেপালের মধ্যে বিদ্যুৎ কেনাবেচার বিশেষ সুযোগ রয়েছে। কারণ, নেপাল জলবিদ্যুৎনির্ভর দেশ এবং তাদের বিপুল পরিমাণ উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে। গ্রীষ্ম মৌসুমে (জুন-নভেম্বর) নেপালে চাহিদার চেয়ে বেশি জলবিদ্যুৎ উৎপাদন হয়, যা ওই সময়ে বাংলাদেশ চাহিদা পূরণে ব্যবহার করতে পারে। আবার শীত মৌসুমে (নভেম্বর-মার্চ) নেপালের অধিকাংশ জলভাগ জমে বরফ হয়ে যায়। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন হ্রাস পায়। সে সময় বাংলাদেশে চাহিদা কমে ৭-৮ হাজার মেগাওয়াটে নেমে আসে। উৎপাদনসক্ষমতার বড় অংশ অলস থাকে। বাংলাদেশ উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ শীত মৌসুমে নেপালে রপ্তানি করতে পারে। এতে উভয় দেশ লাভবান হওয়ার সুযোগ রয়েছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, বিশেষ বিধানে যেখানে দায়মুক্তির ব্যবস্থা রয়েছে, তার অধীনে চুক্তির কারণেই ওই বিদ্যুৎ আমদানি থেকে পিছিয়ে এসেছে বাংলাদেশ। তবে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের স্বার্থ অক্ষুন্ন রেখে নেপাল থেকে আরও বিদ্যুৎ আমদানি হতে পারে। কারণ দেশে উৎপাদিত কয়লা ও তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে নেপালের জলবিদ্যুতের দাম তুলনামূলক সস্তা।
গত ফেব্রুয়ারি মাসে জিএমআর আপার কার্নালি হাইড্রোপাওয়ার লিমিটেডের চেয়ারম্যান এসএন বার্ডে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সচিব বরাবর একটি চিঠি পাঠিয়েছে। তাতে নেপাল থেকে বাংলাদেশে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য পিডিবি, ভারতের এনটিপিসি বিদ্যুৎ ভেপার নিগাম লিমিটেড এবং জিএমআরের সঙ্গে একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তি সইয়ের কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বিশেষ ক্ষমতা আইন বা দায়মুক্তি আইনের আওতায় ওই চুক্তিটির খসড়া তৈরি হয়েছিল ২০২৩ সালে এবং গত বছরের ডিসেম্বরে সেটি চূড়ান্ত করা হয়। এর আওতায় ২০৩০ সাল থেকে পরবর্তী ২৫ বছর বাংলাদেশের ওই বিদ্যুৎ আমদানির কথা ছিল।
ছাত্র-জনতার তীব্র গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার বহুল বিতর্কিত ওই বিশেষ বিধান বিলুপ্ত করে। এমন পরিস্থিতিতে নেপাল থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা থেকে পিছিয়ে এসেছে সরকার।
বাংলাদেশ-ভারত যৌথ সঞ্চালন লাইন: উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্য থেকে ভারতের অন্য অংশে বিদ্যুৎ নিতে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ সঞ্চালন করতে চায় নয়াদিল্লি। আর নেপাল-ভুটান থেকে ভারতের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ আনা নিয়ে বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে ২০১৬ সাল থেকে আলোচনা শুরু হয়।
দীর্ঘ আলোচনার পর ২০২৩ সালে বাংলাদেশ-ভারতের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত দুই দেশের বিদ্যুৎ খাতে সহযোগিতা-সংক্রান্ত যৌথ স্টিয়ারিং কমিটির সভায় দুই দেশ মিলে আন্তঃসংযোগ বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়।সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, দুই দেশের সঞ্চালন কোম্পানির অংশীদারত্বে গঠিত একটি যৌথ বিদ্যুৎ সঞ্চালন কোম্পানি ভারতের কাটিহার থেকে বাংলাদেশের পার্বতীপুর হয়ে আবার দেশটির বরানগর পর্যন্ত ১১৭ কিলোমিটার দীর্ঘ ৭৬৫ কেভির (কিলোভোল্ট) বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন নির্মাণের কথা ছিল।
চাহিদা না থাকায় ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জলবিদ্যুৎ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারছে না দেশটি। বিদ্যুৎ করিডর পেলে ভারতের এ অংশের অতিরিক্ত বিদ্যুৎ অন্য অংশে নেওয়া সহজ হবে। তাই দেশটি দীর্ঘদিন ধরে এ বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। এ বিদ্যুৎ মূলত নদীতে বাঁধ দিয়ে উৎপাদন করা হবে, যাতে ভাটির দেশ বাংলাদেশে পানির প্রবাহ ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
সঞ্চালন লাইনটির নির্মাণকাজ এ বছরের গোড়ার দিকে শুরু করে ২০২৮ সালের মধ্যে শেষ করার প্রস্তাব দিয়েছিল ভারত। তবে, নিরাপত্তা এবং পরিবেশগত উদ্বেগের কথা উল্লেখ করে বাংলাদেশ প্রস্তাবটি সাবধানতার সঙ্গে পর্যালোচনা করছে। প্রস্তাবিত করিডরের জন্য জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্দেশ্যে একটি পরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে ভারতের অরুণাচল প্রদেশে স্থানীয়রা বিক্ষোভ শুরু করেছে ইতিমধ্যেই।বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হওয়ায় যৌথ সঞ্চালন লাইনটি নিয়ে এক ধরনের উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। কারণ এটি বাংলাদেশের জাতীয় গ্রিডের সঙ্গে যুক্ত থাকবে। ফলে ভারতের কোনো ব্যর্থতার কারণে বাংলাদেশের জাতীয় গ্রিডে বড় ধরনের বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে।
বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ২৮ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে। এর বিপরীতে চাহিদা রয়েছে গড়ে সর্বোচ্চ ১৬ হাজার মেগাওয়াট। চাহিদার অতিরিক্ত বিদ্যুৎ সক্ষমতার কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় বাড়ছে। বিশেষ করে বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেও বিভিন্ন কেন্দ্রের জন্য বিপুল পরিমাণ ক্যাপাসিটি চার্জ (কেন্দ্র ভাড়া) গুনতে হচ্ছে সরকারকে। এতে ভর্তুকি ও গ্রাহকের ব্যয় বাড়ছে। অতিরিক্ত এই বিদ্যুৎ নিয়ে বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন ধরেই সরকারকে সতর্ক করে আসছে। বাংলাদেশ বর্তমানে প্রায় তিন হাজার মেগাওয়াটেরও বেশি বিদ্যুৎ আমদানি করছে। সেজন্য বছরে অন্তত ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় হচ্ছে।
আমদানি করা এই বিদ্যুতের মধ্যে ভারত থেকে ২৯৭০ মেগাওয়াট এবং নেপাল থেকে আমদানি হচ্ছে প্রায় ৪০ মেগাওয়াট। এর মধ্যে ভারতের আদানি গ্রুপ থেকেই ১৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হচ্ছে। নেপাল থেকে আরও ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হলে বিদ্যুৎ খাতে আর্থিক চাপ আরও বাড়বে। এর পাশাপাশি রয়েছে পরিবেশগত নানা ঝুঁকি। বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, সরকার এখনো এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি। জাতীয় নিরাপত্তা ও পরিবেশগত ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে প্রস্তাবটি নতুন করে পর্যালোচনা করা হবে।