আজ স্বাধীনতা দিবস। লাইনটা লেখার পরেই মনে হলো, এরপর একগাদা কাব্যময় কথা লিখতে হবে, বাঙ্ময় ভাষায় ফেনিয়ে ফেনিয়ে বলতে হবে স্বাধীনতা কী? অলংকার আর আবেগে ভাসিয়ে দিতে হবে। এরপর ছলছল চোখে আবেগের দোলনায় চেপে দেশ আমার মা, দেশ আমার সব বলে বাংলা সিনেমায় আনোয়ার হোসেনের মতো করে বুক চাপড়াতে হবে। রিপাবলিকে তো মহাজ্ঞানী প্লেটো এমনি এমনিই বলেননি যে, ‘আদর্শ রাষ্ট্র থেকে কবিদের নির্বাসিত করতে হবে’। কিন্তু, আদর্শ রাষ্ট্র হয়ে ওঠার আগে কবিদেরই সাহায্য নেওয়া যাক। স্বাধীনতা কী, এই বলতে গিয়ে শামসুর রাহমান অপূর্ব আবেগে আর বাঙ্ময়তায় লিখেছিলেন ‘স্বাধীনতা তুমি মজুর যুবার রোদে ঝলসিত দক্ষ বাহুর গ্রন্থিল পেশী’। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ এক অসাধারণ ইতিহাস। অনেক তাত্ত্বিক উড়িয়ে দিলেও, একদম শাস্ত্রে লেখা বিপ্লবের মতো অক্ষরে অক্ষরে না ফললেও, জনবিজয়ের এ রকম দারুণ ইতিহাস মানুষের ইতিহাসকে মহিমান্বিত করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকে শ্রেণিসংগ্রাম না বললে সত্যের অপলাপ হয়। কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষেরা ঝাঁপিয়ে পড়ে একটা অহংকারী, শক্তিশালী সেনাবাহিনীকে শেষ পর্যন্ত পর্যুদস্ত করে। ধর্মের ভিত্তিতে পাওয়া দেশে স্বজাতিকে ‘ভাই’ না বলে নীচুজাত হিসেবে দেখার, তার শ্রম শুষে নিয়ে নিজেদের উন্নত করার যে মানস পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী ধারণ করত, তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ। এক মর্মান্তিক সাইক্লোনে দেশের একটা অঞ্চলের মানুষ গণহারে প্রাণ হারালে, নিঃস্ব হলেও যারা শাসকগোষ্ঠীর কাছ থেকে শুধু অবহেলা পেয়েছিল, সেই অন্ত্যজদের লড়াইকে শ্রেণিসংগ্রামের লড়াই না বলাটা নেহাত অসততা।
নির্মমতা কি এখানেই শেষ নাকি? এই টাকাও শেষতক চলে যায় নানা বেগমপাড়ায়। পাকিস্তানি শাসকদের মতোই যারা এ দেশের মানুষকে মাংসপি-, উৎপাদনের মেশিন ছাড়া কিছুভাবে না তারা ইউরোপ আমেরিকায় আলিশান জীবন কাটায়, এদেরই সেই নির্মম কষ্টের ফসলে। এসব দেখে কেউ কেউ প্রশ্ন করতেই পারে? কী লাভ হলো তবে স্বাধীনতা পেয়ে?
কিন্তু না। এত কিছুর পরেও স্বাধীনতা জরুরি। আত্মপরিচয় আর আত্মমর্যাদা মানবজীবনের দুটি অমূল্য সম্পদ। এই দুটি না থাকলে মানবজীবন থাকে না। ফলত, স্বাধীনতা আমাদের সেই প্রাথমিক সম্মানটা দেয়। যেসব দেশের মানুষ শুধু নিজের পরিচয়ের কারণে মার খায়, যারা নিজেদের আত্মচেতনার জন্য জীবন দিয়ে দিচ্ছে, আমরা তাদের কাছে আদর্শ। আমাদের লড়াই তাদের উদ্বুদ্ধ করে। আমাদের পতাকা, আমাদের স্বাধীনতা দিবস নেহাত হয়ে উঠে স্বপ্নের প্রতীক। এই কারণে যখন আমাদের দেশের পতাকা নিয়ে কেউ মাঠে খেলতে নামে, গণিতের আসরে কিংবা অন্য কোনো প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়, তখন আমরা গর্বিত হয়ে উঠি। এই সম্মিলিত গর্ব আত্মপরিচয় থেকে উৎসারিত।
এমনকি কবিও বলে ওঠেন
‘কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে আমি আর লিখবো না বেদনার অঙ্কুরিত কষ্টের কবিতা।
কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে পাতা কুড়োনির মেয়ে শীতের সকালে ওম নেবে জাতীয় সংগীত শুনে পাতার মর্মরে।
কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে ভূমিহীন মনুমিয়া গাইবে তৃপ্তির গান জ্যৈষ্ঠে-বোশেখে, বাঁচবে যুদ্ধের শিশু সসম্মানে সাদা দুধে-ভাতে।’ কথা ছিল একটি পতাকা পেলে আমাদের সব দুঃখ জমা দেব যৌথ-খামারে, সম্মিলিত বৈজ্ঞানিক চাষাবাদে সমান সুখের ভাগ সবাই নিয়ে যাব নিজের সংসারে।
হ্যাঁ, যতই প্রতারিত আর অসম্পূর্ণ ভাবি না কেন, আমাদের স্বাধীনতা আর পতাকাই শেষতক উদ্দীপ্ত করে। আমাদের সংগ্রাম চালানোর স্বপ্ন দেখায়। শেষতক লড়ে যেতে বলে দেশটার জন্য।
দেশ মানে কী? দেশ মানে মানুষ। দেশ মানে প্রকৃতি। দেশ মানে বৃক্ষ, তরুলতা, পশুপক্ষী। এই বৃহৎবোধ আমাদের স্বাধীনতার মানেকে প্রজ্বালিত করে। যেই মুহূর্তে আমরা গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের ভীষণ ঝুঁকিতে আছি, যখন সমুদ্র আমাদের ভাসিয়ে নেওয়ার পাঁয়তারা করছে আমাদের তখন প্রকৃতি রক্ষার লড়াই করতে হবে। আর এই মহাবিপর্যয় যেসব ধনী দেশের শয়তানিতে আসন্ন, তাদের চেপে ধরতে হবে। স্বাধীনতার এই চলমান যুদ্ধ তাই দুইধারী। একদিকে দেশীয় শয়তান আর অন্যদিকে বৈশ্বিক শয়তান। কিন্তু, স্বাধীনতা দিবস তো আমাদের যৌথ খামারে ফসলের হিস্যা বুঝে নেওয়ার প্রেরণাই। কবির ভাষায়
‘বৃক্ষ তোমাদের অভিশাপ দিচ্ছে শস্য তোমাদের অভিশাপ দিচ্ছে রক্ত তোমাদের অভিশাপ দিচ্ছে তোমাদের অভিশাপ দিচ্ছে পৃথিবীর সমস্ত শিশুরা। লক্ষ মৃত্যু আমাদের ফেরাতে পারেনি আমরা এসেছি। আমরা আমাদের শিক্ষাহীনতার কথা বলব, আমরা আমাদের চিকিৎসাহীনতার কথা বলব, আমরা আমাদের গৃহহীনতার কথা বলব, আমরা আমাদের বস্ত্রহীনতার কথা বলব, আমরা আমাদের ক্ষুধা ও মৃত্যুর কথা বলব। আমরা তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা থেকে এসেছি, আমরা সিপাহি আন্দোলনের দুর্গ থেকে এসেছি, আমরা তেভাগার কৃষক, নাচোলের যোদ্ধা আমরা চটকলের শ্রমিক, আমরা সূর্যসেনের ভাই, আমরা একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধ থেকে এসেছি কাঁধে স্টেন, কোমরে কার্তুজ, হাতে উন্মত্ত গ্রেনেড আমরা এসেছি।’
আমাদের এই লড়াই মুক্তিযুদ্ধের অবিশ্বাস্য বিজয়ের স্মৃতি থেকে উদ্বেলিত। আমাদের স্বাধীনতা দিবস শুধু নির্দিষ্ট দিবস না। আমাদের স্বাধীনতা দিবস শুধু ঝাঁ চকচকে অনুষ্ঠান নয়। আমাদের স্বাধীনতা দিবস কষ্টে পাওয়া দেশকে রক্ষার। স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিনের মন্ত্রে উজ্জীবিত।
বিরুদ্ধতার চাবুক ওঠাও হাতে/ তোমার স্বদেশ লুঠ হ’য়ে যায় প্রতিদিন প্রতিরাতে/ তোমার মাঠের ফসল কেন হে/ পরের জাহাজে ওঠে/ খুদকুঁড়ো শুধু তোমার জন্যে/ তা-ও কি দুবেলা জোটে/ বিরুদ্ধতার চাবুক ওঠাও হাতে/ তোমার বুকের ওপর চাপানো/ বিরাট পাষাণ ভার/ তোমাকে পিষছে দেশের মাটিতে/ পুঁজিপতি জমিদার/ তোমার বাঁ পাশে ডান পাশে, সাথী/ উদ্যত বেয়নেট/ দুশমনদের শাবাশ জানায়/ বিদেশি ঘাতক মেলায় যে হাত দেশি ঘাতকের সাথে/ বিরুদ্ধতার চাবুক ওঠাও হাতে।
আমরা একবার যখন রক্ত দিয়েছি, আমরা আরও দেব। জনতার সংগ্রাম চলবেই। এই সংগ্রামের প্রতিটি দিনই স্বাধীনতা দিবস। সেই স্বাধীনতা, যেদিন আমরা যেমন ইচ্ছে লেখার একটি খাতা পাব। পেট ভর্তি খাবারের সঙ্গে, সম্মানের জীবনে মানুষ হয়ে উঠতে পারব।
লেখকঃ সাংবাদিক