মাদকের বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স ঘোষণার পরও মানিকগঞ্জে এর ব্যবসা ও ব্যবহার দ্রুত বাড়ছে। জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) তথ্য বিশ্লেষণ করে এই চিত্র বেরিয়ে এসেছে। মানিকগঞ্জ জেলা গোয়েন্দা পুলিশ মাদকের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করে আসছে। তাদের দেওয়া তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০২২ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৩ মাসে মাদকবিরোধী অভিযান হয়েছে ৫৮টি।
গ্রেপ্তার হয়েছে ১৪৭ জন। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে দুই হাজার ৪৭১ গ্রাম হেরোইন, চার হাজার ৮১৩ পিস ইয়াবা, চার কেজি ১৫০ গ্রাম গাঁজা ও ৮০ বোতল ফেনসিডিল। এসব উদ্ধারকৃত মাদকের মূল্য ধরা হয়েছে প্রায় দুই কোটি ৮১ লাখ টাকা। ডিবির তথ্য বিশ্লেষণ করে পাওয়া যায়নি মাদক ব্যবসার মূল হোতাদের।
যাদের আটক করা হয়েছে, তাদের কাছ থেকে বড় ধরনের কোনো চালান আটক হয়নি। এদের কাছ থেকে অল্প অল্প পরিমাণ মাদক উদ্ধার করা হয়েছে। এরা মূলত নিজেরাই মাদক সেবন করে এবং নিজেদের মধ্যে বেচাকেনা করে। গ্রেপ্তারের পর ছাড়া পেলে ফের মাদক বিক্রি শুরু করে। কিন্তু এদের কাছে যারা মাদক পৌঁছে দেয়, তারা রয়েছে আড়ালেই।
মানিকগঞ্জের সাতটি উপজেলায়ই মাদকের বিস্তার থাকলেও শিবালয় ও সিংগাইর উপজেলায় বেশি। কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানে জানা গেছে, শিবালয়ের আরিচা ঘাট অনেক আগে থেকেই মাদকের হাট হিসেবে পরিচিত। ২০০২ সাল পর্যন্ত এই ঘাট দিয়ে উত্তর ও দক্ষিণ বঙ্গের সঙ্গে ঢাকাসহ পূর্বাঞ্চলের সড়ক যোগাযোগের জন্য ফেরিঘাট চালু ছিল। সে সময় ভারত থেকে ফেনসিডিল, হেরোইন ও গাঁজার চালান আসত বিভিন্ন পণ্য ও যাত্রীবাহী যানবাহনে।
আরিচা ছিল মাদকের ট্রানজিট রুট। আরিচা ঘাটে মাদক, বিশেষ করে ফেনসিডিল ও হেরোইন ব্যবসার গোড়াপত্তন করে মনির ড্রাইভার এবং খোন্দকার পরিবার। পরে ইয়াবার প্রচলন হলে এতেও যোগ দেয় তারা। এই দুই পরিবারের মাদক ব্যবসার বিষয়টি আরিচা ঘাটে ওপেন সিক্রেট। এই দুই পরিবার ছাড়াও আলোচনায় উঠে এসেছে রাজনৈতিক প্রভাবশালী দুজনের নাম। তাদের একজন হচ্ছে সরকারি দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতার ভাই, অপরজন আরেক নেতার ছেলে। এরা দুজন মাদক ব্যবসায় মোটা টাকা বিনিয়োগ করে নিজস্ব এজেন্ট দিয়ে বেচাকেনা করে। মাদক বেচাকেনা ও আসর বসানোর জন্য আরিচা ঘাটে রয়েছে বেশ কয়েকটি স্পট।
পুরনো অগ্রণী ব্যাংক এলাকায় রয়েছে আমেনা, রনি, শিল্পী, সাগর ও সালমার দখলে। এই সালমা অন্তত ২০ বার আটক হয়েছেন। নেহালপুর ও পুরনো টার্মিনাল এলাকায় রহমান, রহিম, মিজান খোন্দকারদের অধীন। পিসিপুল ও গরুর হাট এলাকায় রয়েছেন রিয়াদ, বিলাস, সেন্টু রনি, শহীদ, সজীব ও জুয়েল মাসুদ।
সিংগাইর উপজেলায়ও রয়েছে মাদকের ব্যাপক বিস্তার। সিংগাইর থানা থেকে মাদক ব্যবসায়ী ৪১ জনের একটি তালিকা করা হয়েছে। গত এক মাসে এই থানায় ১৭টি মাদকসংক্রান্ত মামলায় আটক করা হয়েছে ১৭ জনকে। উদ্ধার করা হয়েছে ইয়াবা, হোরোইন, গাঁজাসহ বিপুল পরিমাণ মাদক। প্রায় একই অবস্থা জেলার অন্যান্য উপজেলায়ও।
জেলা মাদকবিরোধী কমিটির সদস্য রাশেদা আক্তার বলেন, ‘ইয়াবা, হেরোইন, ফেনসিডিলের মতো মাদকদ্রব্য দেশে তৈরি হয় না। বাইরে থেকে আসে। পরিস্থিতির উন্নতি করতে হলে বাইরে থেকে দেশে আসা মাদকের চালান আটকানোর বিকল্প নেই।’
মাদকবিরোধী আন্দোলনের কর্মী বিমল রায় বলেন, ‘মাদক নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৮-তে মাদকাসক্তদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের কথা বলা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘শুধু গ্রেপ্তার ও জেল-জরিমানা করে মাদক সমস্যার সমাধান করা যাবে না। মাদকবিরোধী সচেতনতা সৃষ্টি ও সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে প্রতিহত করতে হবে।’
প্রায় চার বছর আগে একটি গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টে মানিকগঞ্জের ১৪ জনের নাম পত্রপত্রিকায় প্রকাশ হওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি প্রশ্ন করেন, ‘এখনো কেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না?’
মাদকবিরোধী অভিযানের নেতৃত্বদানকারী ডিবি পুলিশের ওসি আবুল কালাম বলেন, ‘মাদকের বিরুদ্ধে আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করে আসছি। ব্যবসায়ী ও মাদকাসক্তদের গ্রেপ্তারের পর আদালতে প্রেরণ করি। এরপর আদালত সিদ্ধান্ত নেন।’