সিরিয়ার আকাশে ইসরায়েলি যুদ্ধবিমানের আনাগোনা ক্রমশ বাড়ছে। গত জুলাই ও আগস্ট মাসে ইসরায়েলি সেনারা অন্তত ছয়বার বড় ধরনের হামলা চালিয়েছে। ড্রোন এবং বিমান হামলায় সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের উপকণ্ঠ, সামরিক ঘাঁটি এবং অস্ত্রাগারগুলো ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, সিরিয়ার বর্তমান প্রভাবশালী নেতা আবু মোহাম্মদ আল জুলানী এবং তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান কেন এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কোনো জোরালো প্রতিবাদ করছেন না?
বাশার আল আসাদ সরকারের পতনের পর সিরিয়ার অন্তর্বর্তী সরকারের সবচেয়ে বড় প্রভাবশালী মুখ হয়ে ওঠেন আল জুলানী। একসময় একটি সন্ত্রাসী সংগঠনের নেতা হিসেবে পরিচিত হলেও, এখন তিনি দেশ চালাচ্ছেন। কিন্তু ইসরায়েলি আগ্রাসনের মুখে তার নীরবতা বিশেষভাবে চোখে পড়ছে। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর থেকে ইসরায়েল সিরিয়ায় প্রায় ৪০০-টিরও বেশি হামলা চালিয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ৪০০টি স্থল অভিযানও রয়েছে। সর্বশেষ গত ২৭ আগস্ট দামেস্কের দক্ষিণে আল কিসওয়া এলাকায় সাবেক বিমান প্রতিরক্ষা ঘাঁটিতে ভয়াবহ হামলা হলেও জুলানীর সরকার প্রকাশ্যে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। বরং খবর এসেছে, তুরস্ক ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় তার দলের সঙ্গে ইসরায়েলি প্রতিনিধিদের গোপন বৈঠক হয়েছে, যেখানে ইসরায়েলি হামলা নিয়ে কোনো করা আপত্তি জানানো হয়নি।
অন্যদিকে, তুরস্কের অবস্থানও প্রশ্নবিদ্ধ। গাজায় ইসরায়েলি অভিযানের বিরুদ্ধে এরদোয়ান সরকার সংসদে দাঁড়িয়ে “গণহত্যা” বলে তীব্র সমালোচনা করলেও, সিরিয়ার মাটিতে ইসরায়েলি আক্রমণ প্রসঙ্গে শুধু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নরম সুরের বিবৃতিই দেখা গেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, তুরস্ক মূলত একটি কূটনৈতিক কৌশল নিয়ে ব্যস্ত। একদিকে ফিলিস্তিনের পক্ষে অবস্থান দেখিয়ে জনপ্রিয়তা অর্জন, অন্যদিকে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক পুরোপুরি না ভাঙা। কারণ, মার্কিন মধ্যস্থতায় তুরস্কও চাইছে ইসরায়েলি হুমকি নিয়ন্ত্রণে রাখতে।
ইসরায়েল এসব হামলার পেছনে ইরানের প্রভাব ঠেকানোর অজুহাত দেয়। তারা অস্ত্র মজুদাগার ধ্বংস এবং সীমান্তে প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা করার কথা বললেও বাস্তবে তারা গোলান মালভূমি দখলকে শক্তিশালী করছে। একই সাথে সোয়াইদা এবং উত্তর-পূর্ব সিরিয়ার কুর্দি এলাকায় অস্থিরতা উসকে দিচ্ছে। রয়টার্স জানিয়েছে, ইসরায়েলি মন্ত্রীরা খোলাখুলিই বলছেন যে তাদের মূল লক্ষ্য হলো দক্ষিণ সিরিয়ায় একটি প্রতিরক্ষামূলক অঞ্চল তৈরি করা। এর মধ্য দিয়ে তারা সীমান্ত নিরাপত্তার নামে সিরিয়ার ভেতরে গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে।
মার্কিন কূটনীতিক টম ব্যারাক, যিনি একই সাথে আঙ্কারায় রাষ্ট্রদূত এবং সিরিয়া ফাইলের বিশেষ দূত, প্রকাশ্যে শান্তি ও সমাধানের কথা বলেন। কিন্তু বাস্তবে তিনি ইসরায়েলের হামলা ঢাকতে ব্যস্ত। তিনি লেবানন পর্যন্ত গিয়ে হিজবুল্লাহকে নিরস্ত্রীকরণের চাপ দিচ্ছেন। এমনকি ১৯৭৪ সালের গোলান মালভূমি বিষয়ক চুক্তিও ইসরায়েল এখন কার্যত ভঙ্গ করেছে এবং সীমান্তে নতুন নিরাপত্তা বলয় তৈরি করছে। এই সবকিছুই জুলানীর সরকার শুধু নীরব দর্শকের মতো দেখে যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিরিয়ার সেনা ও নিরাপত্তা কাঠামো এখন ভেঙে পড়েছে। আসাদের পতনের পর দেশ পুনর্গঠনই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সীমিত সামরিক শক্তি দিয়ে ইসরায়েলের মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। অন্যদিকে, নতুন সেনা ও গোয়েন্দা ব্যবস্থার বড় অংশ এখন তুর্কি উপদেষ্টাদের হাতে। ফলে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবই জুলানীর চুপ করে থাকার আসল কারণ।
সব মিলিয়ে, তুরস্ক এবং জুলানী দুজনেই ইসরায়েলি হামলার মুখে কঠোর অবস্থান নিচ্ছেন না। একদিকে প্রকাশ্যে কিছু সমালোচনা, অন্যদিকে আড়ালে নীরব সমঝোতা। আর সেই সুযোগে সিরিয়ার আকাশে প্রতিদিনই ভেসে উঠছে ইসরায়েলি ড্রোন, আর আকাশ কাঁপছে যুদ্ধবিমানের শব্দে।