গাজা যুদ্ধ শুধু ফ্রন্টলাইনের বুলেট আর মিসাইলের লড়াই নয়। ভেতরে ভেতরে আরেক যুদ্ধ চলছে ইসরায়েলি সেনাদের মনে, যা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যকে ভয়াবহভাবে প্রভাবিত করছে। ড্যানিয়েল এদ্রী, মাত্র ২৩ বছর বয়সী একজন সাবেক সেনা, কিছুদিন আগে গাজা থেকে ফিরেছিলেন। রাতের অন্ধকারে তার ঘুম ভেঙে যেত বিস্ফোরণের শব্দে, চোখে ভেসে উঠত সহযোদ্ধাদের নিথর দেহ। চিকিৎসকদের দেওয়া আশ্বাসের পরও তিনি ট্রমা সামলে উঠতে পারেননি। এক সকালে নিজের জীবন নিজেই শেষ করলেন ড্যানিয়েল।
ড্যানিয়েলের গল্পটি এখন আর একা নয়। গত অক্টোবর ২০২৩ থেকে জুলাই ২০২৫ পর্যন্ত ১,১০০-র বেশি ইসরায়েলি সেনা চাকরি ছেড়েছেন মানসিক অসুস্থতার কারণে। সামরিক বাহিনীর দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, এই বিপুল সংখ্যক সেনাকে পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (PTSD)-এর কারণে বাধ্য হয়ে দায়িত্ব ছাড়তে হয়েছে।
সামরিক কমান্ডাররা প্রকাশ্যে বলছেন, যুদ্ধের চেয়েও ভয়ংকর হচ্ছে যুদ্ধোত্তর নিস্তব্ধতা। অনেক সেনা একাধিকবার ফ্রন্টলাইনে মোতায়েন হয়েছেন, এবং বারবার এই পুনরাবৃত্ত চাপই তাদের ভেঙে দিচ্ছে। PTSD-এর অন্ধকার কতটা গভীর হতে পারে, তার নির্মম উদাহরণ হলো আত্মহত্যার সংখ্যা।
শুধু ২০২৪ সালেই ২১ জন ইসরায়েলি সেনা আত্মহত্যা করেছেন, যা এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ।২০২৫ সালে ইতিমধ্যেই আরও ১৭ জন জীবন শেষ করেছেন। এদের বেশিরভাগই রিজার্ভ সৈনিক, যারা সদ্য যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরেছেন।ইসরায়েলি সমাজে ড্যানিয়েল এদ্রীর মৃত্যু আলোচনার ঝড় তুলেছে, কারণ তার মতো আরও শত শত সেনা নীরবে এই যুদ্ধে লড়ছেন এবং অনেকেই হেরে যাচ্ছেন।
সেনাদের মধ্যে মানসিক চাপ বেড়ে যাওয়ায় ইসরায়েলি সেনা কর্তৃপক্ষ ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বিশেষ ইউনিট সম্প্রসারণ করতে বাধ্য হয়েছে। কম্ব্যাট স্ট্রেস রেসপন্স ইউনিট এখন নতুন করে উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলে শাখা খুলছে। একই সঙ্গে, একটি জাতীয় কেন্দ্র গড়ে তোলা হচ্ছে যেখানে সৈনিক এবং তাদের পরিবার চিকিৎসা, মানসিক সহায়তা এবং দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বাসন সুবিধা পাবেন।
তবে সমালোচকরা বলছেন, এই উদ্যোগগুলো অনেক দেরিতে নেওয়া হয়েছে। এবারের মানসিক স্বাস্থ্য সংকট ইসরায়েলের ইতিহাসে নজিরবিহীন। গাজা যুদ্ধ শুরুর পর থেকে অন্তত ২৬,০০০ সৈনিক মানসিক চিকিৎসা নিয়েছেন, যার এক-তৃতীয়াংশের আনুষ্ঠানিকভাবে PTSD ধরা পড়েছে। ২০০৬ সালের লেবানন যুদ্ধের সময় মাত্র ২ শতাংশ সেনা এমন মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হয়েছিলেন, যা বর্তমান সংখ্যার তুলনায় কয়েকগুণ কম।
বিশেষ করে রিজার্ভ সেনাদের পরিস্থিতি আরও সংকটজনক। একটি গবেষণা অনুযায়ী, চলমান যুদ্ধে অংশ নেওয়া ১২ শতাংশ রিজার্ভ সেনার মধ্যে PTSD-এর উপসর্গ দেখা যাচ্ছে। বারবার যুদ্ধক্ষেত্রে যাওয়া, সহযোদ্ধাদের মৃত্যু দেখা এবং নিরবচ্ছিন্ন ভয়ের মধ্যে থাকা—এইসব মিলিয়েই তারা ভেঙে পড়ছেন।
অক্টোবর ২০২৩ থেকে এ পর্যন্ত ৪ লাখ ৫ হাজারের বেশি রিজার্ভ সেনাকে ডাকা হয়েছে, যা ইসরায়েলের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এর মধ্যে প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার এখনো মোতায়েন আছেন। পাশাপাশি, নিয়মিত বাহিনীর প্রায় ১ লাখ সৈনিকও কাজ করছেন। এই বিশাল আকারের মোতায়েন মানসিক চাপকে বহুগুণে বাড়িয়ে তুলেছে।
যুদ্ধক্ষেত্রে ট্যাঙ্ক, ড্রোন বা হাইটেক অস্ত্র দিয়ে লড়া যায়। কিন্তু ভেতরের যুদ্ধ, ভয়, দুঃস্বপ্ন আর অপরাধবোধের বিরুদ্ধে জয়ী হওয়া কঠিন। ইসরায়েলি দখলদার বাহিনী আজ যে মানসিক সংকটে ভুগছে, তা তাদের সামরিক শক্তির গর্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।