আন্দোলনে শহীদদের পরিবার বিচার নিয়ে হতাশার কথার জানিয়েছেন, জানিয়েছেন কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশের স্বপ্ন পূরণ না হওয়ার কথা। গত বছরের ১৬ জুলাই বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে জীবন দিয়েছেন আবু সাঈদ।বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রথম শহীদ আবু সাঈদ। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন চলাকালে ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই রংপুরে পুলিশের গুলিতে নিহত হন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী ও আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আবু সাঈদ।
আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং তা সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভের জন্ম দেয়। এই ঘটনায় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে তীব্র আন্দোলন গড়ে ওঠে। কোটা সংস্কার আন্দোলন রূপ নেয় সরকার পতনের গণঅভ্যুত্থানে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আবু সাঈদের দুই দিকে দুই হাত তুলে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছবিটা বাংলাদেশের মানুষের মনে গেঁথে গেছে। কিন্তু মৃত্যুর এক বছর পর তার পরিবারের সদস্যদের মুখে শুধুই হতাশা। না পেয়েছেন বিচার, না পেয়েছেন কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ।
আবু সাঈদের ভাই আবু হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানের প্রথম শহীদ আবু সাঈদ। সে তো আইকনিক শহীদ। তার আত্মত্যাগ জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানে রাজপথে লড়াই করতে মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে। আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম, আসলে সবাই প্রত্যাশা করেছিল দিনে দুপুরে আবু সাঈদকে গুলি করে মারা হয়েছে এর বিচার দ্রুততম সময়ে হবে। বিচার প্রক্রিয়া ধীরগতিতে চলছে। তদন্ত করতেই এক বছর পার হয়েছে। এখনও আমরা আশাবাদী ড. ইউনূসের শাসনামলেই বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে।
জুলাই অভ্যুত্থানে নিহত আরও কয়েকজনের পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছে ডয়চে ভেলে। সবার পরিবারেই বিচার নিয়ে হতাশা। যে কারণে স্বজনরা জীবন দিয়েছেন, সেই প্রত্যাশিত বাংলাদেশ এখনও মেলেনি। খুন, চাঁদাবাজি, নিরাপত্তাহীনতার এই দেশ নিয়ে হতাশার কথা জানিয়েছেন তারা। এখন পর্যন্ত সরকার মোট ৮৪৪ জন শহীদের নাম গেজেট আকারে প্রকাশ করেছে।
জুলাই আন্দোলন চলাকালে প্রথম নারী শহীদ নাঈমা সুলতানা। ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই বিকেল পাঁচটার দিকে রাজধানীর উত্তরার বাসার বারান্দায় শুকাতে দেওয়া কাপড় আনতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় সে। চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক গোলাম মোস্তফা ও আইনুন নাহার দম্পতির দুই মেয়ে ও এক ছেলের মধ্যে নাঈমা ছিল দ্বিতীয়। সে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে পড়ত।
আমাদের কথা দিয়েছিলেন ২০২৪ এর প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের বিচার উনি করবেন। কিন্তু দীর্ঘ এক বছরে আমরা সেই বিচার দেখিনি। অথচ নাঈমা হত্যাকাণ্ডের ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। স্নাইপার নাঈমাকে গুলি করেছে। সবকিছু ডকুমেন্ট থাকার পরও আমরা বিচারটা দেখতে পাচ্ছি না। আমরা এই বিচারটা চাই। যাতে ভবিষ্যতে যেই সরকারই আসুক এভাবে নির্বিচারে শিক্ষার্থীদের হত্যা করতে না পারে। আমরা আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে মামলা করেছি। একদিন আমরা সেখানে গিয়ে কথাও বলে এসেছি। এরপর কি হয়েছে তা আমরা জানি না। কেউ আর আমাদের সঙ্গে যোগাযোগও করেনি। আমরা সরকারের কাছ থেকে ১০ লাখ টাকার সঞ্চপত্র পেয়েছি। কিন্তু সেটা তিন মাস হয়ে গেলেও অ্যাকটিভ হয়নি। অন্যদেরটা একটিভ হলেও আমাদেরটা হচ্ছে না। অথচ দ্বিতীয় দফায় ২০ লাখ টাকা দেওয়া শুরু হচ্ছে।
জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার আশরাফ আলী ও রেহানা বিবির তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে দ্বিতীয় ছিল রিতা আক্তার (১৭)। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় বিয়ের জন্য চাপ দেয়া হয় রিতাকে। কিন্তু রিতা মা-বাবাকে বলেছিল, ডাক্তার হব। মা-বাবাকে উপার্জন করে না খাওয়ানো পর্যন্ত বিয়ে করব না। পড়ার প্রতি রিতার আগ্রহ দেখে পরিবারটি গ্রাম থেকে ঢাকার মিরপুরে চলে আসে। গত বছরের জুন মাসে ঢাকায় আসে রিতা। তাকে ভর্তি করে দেওয়া হয় দুয়ারীপাড়া সরকারি কলেজে। ৫ আগস্ট বেলা দেড়টায় পরিবার খবর পায়, আন্দোলনে থাকার সময় মিরপুর ১০ নম্বরে ফুটওভারব্রিজের সামনে রিতা মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়েছে। চার হাসপাতালে ছোটাছুটি করে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের মর্গে মেয়ের পা দেখে শনাক্ত করেন মা রেহানা বিবি।
তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, এখন পর্যন্ত আমরা কোনও বিচার পাইনি। গতকাল শুনলাম ড. ইউনূস বলেছেন, তারা এই সরকারের সময়েই বিচারগুলো করবেন। আমরা বিচারের আশায় পথ চেয়ে বসে আছি।রাজধানীর বনানী বিদ্যানিকেতন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র ছিল গোলাম নাফিজ। ওই শিক্ষা- প্রতিষ্ঠান থেকেই এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছিল সে। গত ৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিতে বন্ধুদের সঙ্গে শাহবাগে যাওয়ার সময় ফার্মগেটে ওভারব্রিজের নিচে গুলিবিদ্ধ হয় সে। রিকশার পাদানিতে পড়ে থাকা নাফিসের নিথর দেহের ছবি কাঁদিয়েছে সব মানুষকে। তাদের বাসা মহাখালীতে।
নাফিজের বাবা গোলাম রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, বিচার তো এখনও পাইনি। বিচারের আশায় আমরা দিন গুনছি। আমরা এখনও আশা করি, ড. ইউনূসের শাসনামলেই এই বিচারের কাজ শেষ হবে।হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ে গত বছরের ৫ আগস্ট অন্য আরো ৮ জনের সঙ্গে গুলিতে নিহত হন সাংবাদিক সোহেল আখুঞ্জি। দৈনিক লোকালয় বার্তা নামে হবিগঞ্জের একটি স্থানীয় দৈনিকে কাজ করতে তিনি। তার স্ত্রী মৌসুমী আক্তার ডয়চে ভেলেকে বলেন, আমার স্বামীর বাবা-মা, ভাই-বোন কেউ নেই। আমার ছোট ছোট তিনটা বাচ্চা। ছোট মেয়ের বয়স আড়াই বছর। ফলে মামলা করার সামর্থ্য আমাদের নেই। ওখানে ৯ জন একসঙ্গে মারা গিয়েছিলেন। ওই ঘটনায় একজন মামলা করেছিলেন। ফলে আমরা আলাদাভাবে আর মামলা করিনি। ঘটনার পরপর পুলিশ ১৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছিল বলে শুনেছি। পরে আর কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। বিচারের আশায় দিন গুনছি আমরা।
আবু সাঈদের ভাই আবু হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, আমার ভাই তো জীবন দিয়েছেন বৈষম্যের বিরুদ্ধে। প্রথম যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, সেটা কোটার বিরুদ্ধে, বৈষম্যের বিরুদ্ধে। যে বৈষম্যের বিরুদ্ধে আমার ভাই বা অন্যরা জীবন দিয়েছেন সেই বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশের পরিপূর্ণ রূপ আমরা পাইনি। আমরা এখনও দেখছি, সেই চাঁদাবাজি, দিনে দুপুরে মানুষ হত্যা হচ্ছে। আমরা চাই সামনে যে নির্বাচিত সরকার আসবে তারা যেন স্বৈরশাসন থেকে শিক্ষা নেয়। তারা যেন জনবান্ধব সরকার হয় সেটা আমরা প্রত্যাশা করি। তবে এক বছর পর এসেও কাঙ্ক্ষিত বৈষম্যমুক্ত দেশ আমরা পাইনি।
নাঈমা সুলতানার মা আইনুর নাহার ডয়চে ভেলেকে বলেন, চারদিকের খবর দেখে তো বোঝা যায় কি অবস্থা! এখনও খুন হচ্ছে। মানুষের জীবন যাচ্ছে। এই হত্যাগুলোর বিচার যদি করা যেত তাহলে পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হতো।
রিতা আক্তারের মা রেহেনা বিবি ডয়চে ভেলেকে বলেন, এখনও তো অস্থায়ী সরকার। আমরা দেখছি, ড. ইউনূস চেষ্টা করছেন। স্থায়ী সরকার না আসা পর্যন্ত বোঝা যাবে না। যে গুলিতে আমার মেয়ে মারা গেল, এমনভাবে যেন আর কারো মেয়েকে জীবন দিতে না হয়। এমন স্বৈরাচারী সরকার যেন না আসে। যেভাবে পাখির মতো গুলি করে আমার মেয়েকে মারা হয়েছে, অন্য সন্তানদের মারা হয়েছে এমন সরকার যেন আর না আসে।
গোলাম নাফিজের বাবা গোলাম রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, এখনও তো মানুষ খুন হচ্ছে। চাঁদাবাজি হচ্ছে। এমন বাংলাদেশের জন্য তো আমার ছেলে জীবন দেয়নি। আমরা প্রত্যাশা করি, এই দেশটা অনেক সুন্দর হবে। এখানে কোন অপরাধ থাকবে না, চাঁদাবাজি থাকবে না। আমার ছেলের মতো কাউকে জীবন দিতে হবে না।সোহেল আখুঞ্জির স্ত্রী মৌসুমী বলেন, যে বাংলাদেশের জন্য আমার স্বামী জীবন দিয়েছেন সেই বাংলাদেশ তো আমরা পাইনি। এখনও তো দেশে নিরাপত্তা নেই। ভয়ে ভয়ে থাকতে হয়। বাড়ি থেকে বের হতে ভয় লাগে। বাচ্চাদের স্কুলে নিয়ে যেতে ভয় লাগে। এমন বাংলাদেশ তো চাইনি। আমরা চাই দেশটা যেন শান্ত থাকে। সবার যেন নিরাপত্তা থাকে। যে ভাইয়েরা মারা গেছে, তাদের হত্যাকারীদের ধরা হয়নি। বিচার হয়নি, এমন দেশ তো আমরা চাইনি।
গত বছরের ২০ জুলাই শনির আখড়ায় টিসিবির পণ্য বিক্রি করছিলেন ইউসুফ সানোয়ার। সেখানে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান তিনি। ইউসুফ সানোয়ারের বোন বিউটি বেগম ডয়চে ভেলেকে বলেন, এখনও আমরা কোন বিচার পাইনি। বিচারের আশায় আছি। এক বছর পর এসে মনে হচ্ছে, সবাই স্বার্থপর হয়ে গেছে। আগে যারা পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, এখন কাছে গেলে কথাও বলেন না। আমরা চাইলেও কারও সঙ্গে দেখা করতে পারি না। এমন অবস্থায় আদৌ বিচার পাব কিনা জানি না। এমন দেশের জন্য তো আমার ভাই জীবন দেয়নি।