২০২৫ সালের ৫ মার্চ, ঢাকা শহরের এক জনাকীর্ণ আদালতে দাঁড়িয়ে ছিলেন সাংবাদিক ফারজানা রূপা। তার পাশে কোনো আইনজীবী ছিল না। বিচারক তার বিরুদ্ধে আরও একটি হত্যাকাণ্ডের মামলা গ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু করেন। আগেই কারাগারে থাকা রূপা মাথা নিচু করে শুধু জামিনের আবেদন করেন। বিচারক জানান, এটি একটি আনুষ্ঠানিক শুনানি মাত্র।‘আমার বিরুদ্ধে এরই মধ্যে ডজনখানেক মামলা ঝুলছে’, বলেন রূপা। ‘আমি একজন সাংবাদিক। একটা হত্যা মামলা আমাকে ফাঁসানোর জন্য যথেষ্ট।’
বেসরকারি একাত্তর টেলিভিশনের সাবেক প্রধান প্রতিবেদক রূপার বিরুদ্ধে এখন নয়টি হত্যা মামলা চলছে। তার স্বামী ও চ্যানেলটির সাবেক বার্তা প্রধান শাকিল আহমেদের নাম রয়েছে আটটি মামলায়।এক বছর আগে, শিক্ষার্থী আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং দেশত্যাগের পর শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব নেন। ওই আন্দোলনে দুইজন সাংবাদিক নিহত হন।
ক্ষমতায় এসেই ইউনূস সংবাদমাধ্যম সংস্কারের অঙ্গীকার করেন এবং সাংবাদিকদের দমনে ব্যবহৃত ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন’ বাতিল করেন। কিন্তু ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে ‘ডেইলি স্টার’-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইউনূস বলেন, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ডের অভিযোগগুলো ‘তাড়াহুড়ো করে’ আনা হয়েছে। তিনি জানান, এ ধরনের পদক্ষেপ বন্ধ করা হয়েছে এবং বিষয়গুলো পর্যালোচনায় একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
তবুও, এক বছর পেরিয়ে গেলেও ফারজানা রূপা, শাকিল আহমেদ, শ্যামল দত্ত এবং মোজাম্মেল হক বাবু এখনো জেলেই রয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে যেসব হত্যা মামলা দেওয়া হয়েছে, তা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ চারজনই সাবেক সরকারের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত।
সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হত্যামামলার পাশাপাশি সাংবাদিক নিপীড়নের আরও নানা রূপ উঠে এসেছে। কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে) জানিয়েছে, সাংবাদিকদের শারীরিকভাবে আক্রমণ, রাজনৈতিক কর্মীদের হুমকি এবং নির্বাসনে যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল অন্তত ২৫ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে তদন্ত চালাচ্ছে, যেটি শেখ হাসিনা সরকারের ঘনিষ্ঠদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত একটি চরম অভিযোগ।
সিপিজে’র আঞ্চলিক পরিচালক বেহ লিহ ই বলেন, ‘যথোপযুক্ত প্রমাণ ছাড়াই চার সাংবাদিককে বছরের পর বছর কারাগারে রাখা অন্তর্বর্তী সরকারের গণমাধ্যম স্বাধীনতা রক্ষার প্রতিশ্রুতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রকৃত সংস্কার মানে হচ্ছে অতীতের নির্যাতন থেকে বেরিয়ে আসা, সেগুলোর পুনরাবৃত্তি নয়।’
সিপিজে’র পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সাংবাদিকদের নাম অনেক সময় ‘প্রথম তথ্য প্রতিবেদন’ (এফআইআর)-এ অনেক পরে যুক্ত করা হচ্ছে। এফআইআর দায়ের না হলে অভিযুক্তরা জামিন চাইতেও পারেন না। মে মাসে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করেন যে, গত বছরের আন্দোলনের ঘটনায় অন্তত ১৪০ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যামামলা করা হয়েছে।
শ্যামল দত্তের মেয়ে শশী সিপিজেকে বলেন, তাদের পরিবার এখন আর জানেই না কতগুলো মামলায় তার বাবার নাম আছে। তারা অন্তত ছয়টি মামলার কথা জানেন। বাবুর পরিবারের দাবি, তার বিরুদ্ধে ১০টি মামলা হয়েছে। রূপা ও শাকিলের পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, পাঁচটি মামলার এফআইআর তারা পাননি, ফলে জামিনের আইনি প্রক্রিয়াও শুরু করা যায়নি।
এ বিষয়ে ড. ইউনূসের প্রেস সচিব শফিকুল আলম এবং পুলিশের মুখপাত্র এনায়েতুল হক সাগরকে ইমেইলে যোগাযোগ করা হলেও তারা সাড়া দেননি।
২০২৫ সালে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে রাজনৈতিক ইস্যুতে সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে সাংবাদিকরা সহিংসতা ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন। সিপিজে’র নথি অনুযায়ী, এ ধরনের অন্তত ১০টি ঘটনার তথ্য পাওয়া গেছে। বেশির ভাগ ঘটনা বিএনপি এবং ছাত্রদল সংশ্লিষ্ট কর্মীদের দ্বারা সংঘটিত হয়েছে। সাংবাদিক বাহার রায়হান, আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ এবং রকিব হোসাইনকে মারধর করা হয়, ফোন কেড়ে নেওয়া হয় এবং ভিডিও ফুটেজ মুছে ফেলা হয়।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের উপদেষ্টা মাহদি আমিন সিপিজেকে বলেন, বিএনপির মতো বড় একটি দলে বিচ্ছিন্ন কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটতেই পারে, তবে দল অপরাধীদের রক্ষা করে না।
অন্যদিকে, শেখ হাসিনার পতনের পর যেসব ছাত্র সংগঠন আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়, তাদের তরফ থেকেও সাংবাদিকদের হুমকি দেওয়া হয়েছে। জামায়াতে ইসলামী বা ইসলামী ছাত্রশিবির নিয়ে কাজ করা সাংবাদিকরা বিশেষভাবে চাপের মুখে পড়েছেন। ৯ জুন, EyeNews.news-এর সম্পাদক হাসনাত কামাল সিপিজেকে জানান, ইসলামী ছাত্রশিবিরের হাতে ভুল অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে তিনি যুক্তরাজ্যে পালিয়ে গেছেন। স্থানীয় দৈনিক দাবানল-এর সাংবাদিক আনোয়ার হোসেন সিপিজেকে জানান, জামায়াতের এক নেতার বিরুদ্ধে রিপোর্ট প্রকাশের পর তার পরিবার হুমকির মুখে পড়ে।
হাসিনার পতনের পর ঢাকায় ‘প্রথম আলো’ পত্রিকার সামনে ছাত্র আন্দোলনকারীদের বিক্ষোভ এবং সামরিক সদস্যদের অবস্থান নেওয়ার ছবিও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে। ২০২৪ সালের নভেম্বরে ঘটে যাওয়া এই ঘটনায় প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টার-এর মতো সংবাদমাধ্যমও ছাত্রদের ঘেরাওয়ের শিকার হয়।
ছাত্র সংগঠন ‘অ্যান্টি-ডিসক্রিমিনেশন স্টুডেন্টস মুভমেন্ট’ (এডিএসএম)-এর কর্মীদের অভিযানে পাঁচজন সাংবাদিক চাকরি হারান। সংগঠনটির নেতা রিফাত রশিদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সিপিজে কোনো জবাব পায়নি।২০২৫ সালের ১৪ জুলাই নির্বাসিত অনুসন্ধানী সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের খান, যিনি শেখ হাসিনার শাসনামলে দুর্নীতি উন্মোচনের পর হুমকির মুখে দেশ ছাড়েন, এক্স-এ লেখেন: ‘যতই কিছু পরিবর্তন হোক, কিছু জিনিস একই থেকে যায়।’