সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হজরত মুহাম্মদ (স.) দুনিয়াতে এসেছেন শেষ নবী হয়ে। কিন্তু নবীজির নবুয়ত নির্ধারণ হয়েছে অনেক আগে। এ বিষয়ে সহিহ হাদিসে এসেছে, আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, লোকেরা প্রশ্ন করল- يَا رَسُولَ اللَّهِ مَتَى وَجَبَتْ لَكَ النُّبُوَّةُ ‘হে আল্লাহর রাসুল, আপনার নবুয়ত কখন অবধারিত হয়েছে?’ জবাবে তিনি বলেন- وَآدَمُ بَيْنَ الرُّوحِ وَالْجَسَدِ ‘যখন আদম (আ.) তাঁর শরীর ও রুহের মধ্যে ছিলেন।’ (সুনানে তিরমিজি: ৩৬০৯)
নবীজি দুনিয়াতে ৪০ বছর বয়সে প্রথম ওহিলাভের মাধ্যমে নবুয়তপ্রাপ্ত হন। এর আগে তিনি আল্লাহর ইবাদত করতেন এবং সবরকম গুনাহ থেকে, যাবতীয় ত্রুটি থেকে মুক্ত থাকতেন। যেহেতু তিনি আল্লাহর নির্ধারিত নবী, তাঁর শুভাগমনকে কেন্দ্র করে এবং শিশু অবস্থায় বিভিন্ন অলৌকিক ঘটনাও প্রকাশ হয়েছে। সিরাতের গ্রন্থগুলোতে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা এসেছে।
নবীজির কাছে একসময় নির্জনতা প্রিয় হয়ে যায়। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘অতঃপর তাঁর কাছে নির্জনতা পছন্দনীয় হয়ে দাঁড়ায় এবং তিনি হেরা গুহায় নির্জনে অবস্থান করতেন। আপন পরিবারের কাছে ফিরে এসে কিছু খাদ্যসামগ্রী সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার আগে সেখানে তিনি একনাগাড়ে বেশ কয়েক দিন ইবাদাতে মগ্ন থাকতেন। অতঃপর খাদিজা (রা.)-এর কাছে ফিরে এসে আবার একই সময়ের জন্য কিছু খাদ্যদ্রব্য নিয়ে যেতেন।’ (সহিহ বুখারি: ৩)
মাসাধিক কালের জন্যও তিনি হেরা গুহায় চলে যেতেন, বিশেষত প্রত্যেক বছর রমজানে তিনি সেখানে অবস্থান করতেন। নবুয়তের ঊষালগ্নে তিনি সেখানে প্রায় ছয় মাস অবস্থান করেন। (আর-রাহিকুল মাখতুম, পৃষ্ঠা-৮৩; আস-সিরাতুন নববিয়া: আরজুন ওয়া ওকায়িউন, পৃষ্ঠা: ৭২-৭৪)
হেরাগুহা বেছে নেওয়ার কিছু ঐতিহাসিক কারণও আছে। যেমন- এখান থেকে কাবা দেখতে পাওয়া, নির্জনতা এবং এখানে দাদা আবদুল মুত্তালিবের ইতেকাফ করা ইত্যাদি। সিরাতে ইবনে হিশামে লেখা হয়, ইসলাম আগমনের আগেও কোরাইশরা রমজানে মূর্তিপূজা ছেড়ে পাহাড়ে গিয়ে ইবরাহিমি ধর্মমতে ইবাদত-বন্দেগি করত। রাসুলুল্লাহ (স.)-ও প্রতি বছর রমজানে নির্জনে আল্লাহর ইবাদত করতেন। (সিরাতে ইবনে হিশাম, পৃষ্ঠা-৫৩)
কথিত আছে, কুরাইশের ভেতর সর্বপ্রথম রাসুলুল্লাহ (স.)-এর দাদা নির্জনতা বেছে নেন এবং গারে হেরায় ইতেকাফ করতেন। বার্ধক্যে মহানবী (স.) তাঁর সঙ্গী হয়েছিলেন। পরবর্তীতে দাদার স্থানে তিনি ইতেকাফ শুরু করেন। চাচারাও তাঁকে স্থান ছেড়ে দেন। (সিরাতে ইবনে হিশাম, পৃষ্ঠা ৫৩; ফাতহুল বারি: ১২/৩৫৫)
নবীজি ওখানে কোন পদ্ধতিতে ইবাদত করতেন তার সুস্পষ্ট বর্ণনা পাওয়া যায় না। তবে বিশুদ্ধ মত হলো, এ সময় তিনি সুনির্দিষ্ট কোনো পদ্ধতিতে ইবাদত করতেন না, বরং তিনি স্বজাতির শিরক ও কুফর থেকে দূরে থাকতেন এবং আল্লাহ ও তাঁর সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতেন। এছাড়াও সীরাতগ্রন্থে রয়েছে, হেরা গুহায় ইবাদত-বন্দেগির পাশাপাশি তিনি পথিকদের পানি পান করাতেন এবং খাবার খাওয়াতেন। (আর-রাহিকুল মাখতুম, পৃষ্ঠা-৮৩)
তবে কারো কারো মতে, তিনি দ্বীনে হানিফ অনুসারে ইবাদত করতেন। দ্বীনে হানিফ হলো ইবরাহিম (আ.) প্রবর্তিত শিরকমুক্ত ইবাদত পদ্ধতি, যার কিছুটা তখনো আরবে অবশিষ্ট ছিল। (হাদায়িকুল আনওয়ার ওয়া মাতালিউল আসরার, পৃষ্ঠা-১২০)
নবুয়ত লাভের আগে রাসুলুল্লাহ (স.) যে পদ্ধতিতেই ইবাদত করুন না কেন, তিনি কখনো শিরক করেননি। সমগ্র আরবে মূর্তি পূজা ছড়িয়ে পড়লেও তিনি কখনো তাতে লিপ্ত হননি। (মাজমাউল জাওয়ায়েদ: ২/২২৮)। নবুয়তের আগে তিনি যে পদ্ধতিতে যে যে ইবাদত করেছেন, তা হেদায়াত বা চূড়ান্ত আসমানি নির্দেশনা ছিল না। এজন্য পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তিনি তোমাকে পেলেন পথ সম্পর্কে অনবহিত, অতঃপর তিনি পথের নির্দেশ দিলেন।’ (সুরা দুহা: ৭)