সাহাবিদের সম্পর্কে সঠিক আকিদা ও দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করা প্রত্যেক মুসলমানের ঈমানের অপরিহার্য অংশ। তাদের সম্মান রক্ষা করা ও তাদের জীবন থেকে শিক্ষা নেওয়া ইসলামের মৌলিক শিক্ষা। এই আলোচনায় কোরআন ও হাদিসের আলোকে সাহাবায়ে কেরামের ঈমানকে সত্যের মানদণ্ড হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে, যা আমাদের সঠিক পথের দিশা দিতে সহায়তা করবে।
যারা ঈমানের অবস্থায় নবীজিকে দেখেছেন তারাই সাহাবি। আর আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের সর্বসম্মত আকিদা হলো, الصحابة كلهم عدول অর্থ: ‘সমস্ত সাহাবা আদেল।’ আকিদার প্রসিদ্ধ গ্রন্থ আল মুসায়ারার ব্যাখ্যাগ্রন্থ আল মুসামারায় বর্ণনা আছে, اعتقاد اهل السنة والجماعة تزكية جميع الصحابة رضى الله عنهم وجوبا باثبات العدالة لكل منهم والكف عن الطعن فيهم والثناء عليهم- অর্থাৎ, আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকিদা হলো, সাহাবাগণ আদেল। তাদের দোষচর্চা থেকে বিরত থাকা এবং গুণকীর্তন করা আমাদের জন্য ওয়াজিব। সাহাবায়ে কেরাম আদেল বা মিয়ারে হক, এতে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অন্তর্ভুক্ত কারো দ্বিমত নেই।
পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন জায়গায় সাহাবায়ে কেরাম সম্পর্কে অনেকগুলো আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় তাদের ইমানকে আমাদের ইমান মাপার অস্ত্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। রব্বুল আলামিন বলেন, و إذا قيل لهم امنوا كما امن الناس قالوا أنؤمن كما امن السفهاء ألا إنهم هم السفهاء و لكن لا يعلمون অর্থ: যখন তাদেরকে বলা হলো, তোমরা ইমান আনয়ন কর মানুষেরা যেভাবে ইমান এনেছে, তখন তারা বলল, আমরা কী বোকাদের মতো ইমান গ্রহণ করব? রব বললেন, মনে রেখো-প্রকৃত অর্থে তারাই বোকা (সুরা বাক্বারা : ১৩)।
উপরের আয়াতে ‘নাস’ শব্দের মাধ্যমে সাহাবিগণকে বোঝানো হয়েছে। কেননা, কোরআন নাজিলের যুগে তারাই ঈমান এনেছিলেন। তাই কাফেরদের সামনে সাহাবায়ে কেরামের ঈমানকে রূপরেখা স্বরূপ উপস্থাপন করা হয়েছে। অর্থাৎ ‘তোমরা সাহাবাদের ঈমানের মতো ঈমান গ্রহণ কর। কারণ, সাহাবাদের ঈমান হলো ঈমানের মাপকাঠি।’
অন্যত্র আল্লাহ তাআলা কোরআনে বলেন,
فإن امنوا بمثل ما امنتم به فقد اهتدوا و إن تولوا فإنما هم في شقاق অর্থ: যদি তারা ঈমান গ্রহণ করে যে-রকম তোমরা ঈমান আনয়ন করেছো, তবেই তারা হেদায়েতপ্রাপ্ত হবে। আর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে তারা হঠকারিতার মধ্যে রয়েছে (সুরা বাক্বারা : ১৩৭)।
এ আয়াতে ‘তোমরা ইমান আনয়ন করেছো বাক্যে’ সাহাবায়ে কেরামকে মুখাতব করা হয়েছে। তাদের ইমানকে ইমানের আদর্শ বা মাপকাঠি বলে ঘোষণা করা হয়েছে। নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, মহান আল্লাহর স্বীকৃত ইমান হলো সাহাবায়ে কেরামের ইমান। সুতরাং সকল সাহাবাগণ সত্যের মানদণ্ড হিসেবে বিবেচিত হবেন।
সুরা আনফালের বর্ণনা, أُولَٰئِكَ هُمُ الْمُؤْمِنُونَ حَقًّا ۚ لَّهُمْ دَرَجَاتٌ عِندَ رَبِّهِمْ وَمَغْفِرَةٌ وَرِزْقٌ كَرِيمٌ অর্থ: তারাই হলো সত্যিকার ঈমানদার! তাদের জন্য রয়েছে স্বীয় পরওয়ারদেগারের নিকট মর্যাদা, ক্ষমা এবং সম্মানজনক রুজি। উপরিউক্ত আলোচনা প্রমাণ করে, পবিত্র কোরআন সত্য ও দীনের মানদণ্ড হিসেবে সাহাবাদেরকে উপস্থাপন করেছে।
রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
ان بنى اسرائيل تفرقت على ثنتين وسبعين ملة وستفترق أمتي على ثلث وسبعين ملة كلهم في النار الا واحدة – قالوا من هم يا رسول الله قال : ما انا عليه و في رواية قالوا من هم يا رسول الله قال أهل السنة والجماعة فقيل و من اهل السنة والجماعة فقال ما انا عليه واصحا بي অর্থ: বনি ইসরাইল ৭২ দলে বিভক্ত হয়েছিল এবং আমার উম্মত ৭৩ দলে বিভক্ত হবে, তাদের সকলেই হবে জাহান্নামি কেবল মাত্র একটি দল ছাড়া। প্রশ্ন করা হলো, হে আল্লাহর রসুল! সেই মুক্তিপ্রাপ্ত দল কোনটি? নবিজি উত্তর দিলেন, আমি এবং আমার সাহাবায়ে কেরামের তরিকা ও আদর্শের ওপর যারা থাকবে তারাই হবে নাজাতপ্রাপ্ত। অন্য বর্ণনামতে, হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তর দিলেন, নাজাতপ্রাপ্ত দল হলো আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাত। পুনরায় প্রশ্ন করা হলো, আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাত কারা? নবিজি সা. উত্তরে বললেন, আমার ও আমার সাহাবিদের তরিকা ও আদর্শ যারা মেনে চলবে তারা।
অন্য হাদিসে উমর রা. বর্ণনা করেন, আমি রসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন,
سألت ربي عن اختلاف أصحابي من بعدي ، فأوحى إلي : يا محمد ! إن أصحابك عندي بمنزلة النجوم في السماء ، بعضها أقوى من بعض ، ولكل نور ، فمن أخذ بشيء مما هم عليه من اختلافهم فهو عندي على هدى অর্থ: আমার পরে আমার সাহাবাদের মতভেদ সম্পর্কে আমি আল্লাহকে জিজ্ঞেস করলাম। আমাকে ওহির দ্বারা অবহিত করা হয় যে, হে মুহাম্মদ! আপনার সাহাবাগণ আমার নিকট আকাশের তারকারাজির মতো। তাদের কেউ আবার অন্য থেকে অধিক দীপ্তিমান। তবে প্রত্যেকের নিকট হেদায়াতের আলো আছে, সুতরাং তাঁদের মধ্যে পরস্পর বিরোধমূলক যেকোনো বিষয় কেউ গ্রহণ করুক না কেনো, সে আমার নিকট হেদায়াতপ্রাপ্ত বলে বিবেচিত হবে।
এভাবে কোরআন-হাদিসের অসংখ্য আয়াত ও হাদিস দ্বারা সাহাবায়ে কেরাম মিয়ারে হক হিসেবে প্রমাণিত। তারা যেভাবে দীনকে বুঝেছেন, যেভাবে দীনকে পালন করেছেন, সেভাবেই উম্মতে মুসলিমা কিয়ামত পর্যন্ত পালন করে যাবে।
এছাড়া দুনিয়ার সকল পণ্ডিত সালাফ-খালাফ, উলামা-ফুকাহাদের ঐক্যবদ্ধ মতামত এটাই যে, নবিজির সহচরগণ আদেল। তারা দীনের সঠিক দিকনির্দেশক। ইমাম ইবনে হুমাম রহ. বলেন, আহলুস সুন্নাত ওয়াল-জামা’আতের আকিদা হলো, সকল সাহাবায়ে কেরামকে কে পূত ও পবিত্র মনে করা, তাঁদের ওপর আপত্তি উত্থাপন থেকে বেঁচে থাকা এবং তাদের প্রশংসা করা ওয়াজিব (মুসায়েরা: পৃ. ১৩২)
ইমাম আবু হানিফা রহ.বলেন, مقام احدهم مع رسول الله صلى الله عليه وسلم ساعة واحدة، خير من عمل احدنا جميع عمره،وان طال অর্থ: নবীজির সঙ্গে একজন সাহাবির এক মুহূর্তের অবস্থান আমাদের আজীবনের আমলের চেয়েও উত্তম, আমাদের জীবন যতই দীর্ঘ হোক না কেনো (মানাকিবু আবি হানিফা : ৭৬)।
সাহাবায়ে কেরাম সম্পর্কে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত হলো-
ونحب أصحاب رسول الله صلى الله عليه وسلم، ولا نفرط في حب أحد منهم، ولا نتبرأ من أحد منهم، ونبغض من يبغضهم وبغير الحق يذكرهم، ولا نذكرهم إلا بخير، وحبهم دين وإيمان وإحسان، وبغضهم كفر ونفاق وطغيان] . (وَمَنْ أَحْسَنَ الْقَوْلَ فِي أَصْحَابِ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم وَأَزْوَاجِهِ الطَّاهِرَاتِ مِنْ كُلِّ دَنَسٍ، وَذُرِّيَّاتِهِ الْمُقَدَّسِينَ مِنْ كُلِّ رِجْسٍ؛ فَقَدْ بَرِئَ مِنَ النِّفَاقِ.) অর্থ: আমরা নবীয়ে আহমাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহাবিদেরকে ভালোবাসি। তাদের কারো প্রতি ভালোবাসায় সীমালঙ্ঘন করি না এবং কারো প্রতি সম্পর্কহীনতা উচ্চারণ করি না। যারা সাহাবিদের প্রতি বিদ্বেষ করে বা ঘৃণা করে বা উত্তম পদ্ধতি ছাড়া তাদের আলোচনা করে, আমরা তাদেরকে ঘৃণা করি। উত্তম পদ্ধতি ছাড়া আমরা তাদের আলোচনা করি না। সাহাবাদেরকে ভালোবাসা ঈমান ও হৃদয়ের পবিত্রতা। তাদের প্রতি ঘৃণা পোষণ করা কুফর, নিফাক ও নাফরমানি। যে ব্যক্তি নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবি, সহধর্মিণী ও বংশধরগণ সম্পর্কে উত্তম মন্তব্য করল, সে নিফাক থেকে মুক্ত হলো।
সুতরাং সাহাবিগণের সমালোচনাকারীদের সম্পর্কে আমাদের আকাবিরদের স্পষ্ট বক্তব্য, ১.সাহাবায়ে কেরামকে (রা.) গালি দেয়া, তাদের সম্পর্কে অশোভনীয় ভাষা ব্যবহার, তাদের সমালোচনা, তাদের ব্যাপারে কুৎসা রটনা সম্পূর্ণ নাজায়েজ ও হারাম। একজাতীয় কাজের কারণে একজন মুসলিম আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত থেকে বের হয়ে পথভ্রষ্ট ফেরকার অন্তর্ভুক্ত হয়।
২. সাহাবায়ে কেরামের সমালোচনা, তাদের প্রতি কুধারণা ও তাদের কুৎসা রটনা করা বিধর্মী যিন্দিকদের কাজ। ৩. সাহাবায়ে কেরাম রা. সম্পর্কে সুধারণা পোষণ করা ওয়াজিব। ৪. সর্বদা সাহাবায়ে কেরাম রা. এর ভালো গুণাবলি সম্পর্কে আলোচনা করা উচিত। ৫. সব সাহাবিই রসুল সা. এর প্রিয় ছিলেন। ৬. সাহাবায়ে কেরাম রা.-এর সমালোচনাকারীদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা জরুরি।
৭. অনেক সময় সাহাবিদেরকে গালাগালি করার কারণে মানুষ ইসলাম থেকে বের হয়ে যায়। ৮. সাহাবায়ে কেরাম রা.-এর প্রতি ভালোবাসা ঈমানের শর্ত ও চাহিদা, তাদের প্রতি বিদ্বেষ বে-ইমানির আলামত।
সাহাবায়ে কেরাম ইসলামের সত্য পথের নির্ভরযোগ্য দৃষ্টান্ত। তাদের ঈমান, চরিত্র ও জীবনাদর্শ মুসলিম উম্মাহর জন্য অনুকরণীয় ও অনুসরণীয়। পবিত্র কুরআন ও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদিসে তাদের মর্যাদা স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে, যা প্রমাণ করে যে, তারা সত্য ও হকের মানদণ্ড।
সাহাবিদের অনুসরণ ছাড়া শুদ্ধ বিশ্বাস ও সঠিক ইসলামি অনুশীলন সম্ভব নয়। তাদের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন, তাদের জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণ ও তাদের আদর্শের অনুসরণ আমাদের ঈমানের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। সাহাবিদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করা বা তাদের সম্পর্কে কুধারণা রাখা শুধু ধর্মীয় বিচ্যুতি নয়, বরং এটি ঈমানের জন্যও হুমকিস্বরূপ।
অতএব, আমাদের উচিত সাহাবায়ে কেরামের প্রতি ভালোবাসা পোষণ করা, তাদের জীবনাদর্শ অনুসরণ করা আর তাদের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা। তাদের পথে চলাই মুক্তির পথ, আর এই পথেই রয়েছে দুনিয়া ও আখিরাতের সফলতা।