ইসলামি বিশ্বাসমতে, দুনিয়া একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে। প্রাণী মাত্রই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। এরপর পুনরুত্থান হবে। আর কোনো মৃত্যু নেই। সেই আখেরাত বা পরকাল হবে সবার স্থায়ী ঠিকানা। কেউ দুনিয়ার কৃতকর্মের ফলস্বরূপ চিরস্থায়ী জান্নাতে যাবে, কেউবা জাহান্নামে। সেদিন দুনিয়ার দুঃখ কষ্টকে তুচ্ছ মনে হবে জান্নাতিদের। পক্ষান্তরে অবিশ্বাসীদের মনে হবে, দুনিয়াতে তারা সুখ-শান্তি বলতে কিছুই দেখেনি।
হাদিশ শরিফে বর্ণিত হয়েছে, কেয়ামতের দিন অবিশ্বাসীদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তিকে হাজির করা হবে, যে ব্যক্তি দুনিয়ায় আরাম-আয়েশে দিন কাটিয়েছে। বলা হবে, তোমরা (ফেরেশতারা) একে জাহান্নাম থেকে একবার ডুবিয়ে আনো। অত:পর তাকে জাহান্নামে একবার ডুবিয়ে আনা হবে। তারপর তাকে জিজ্ঞেস করা হবে, হে অমুক! তুমি কি কখনো সুখের ছোঁয়া পেয়েছ? সে বলবে, না, আমি কখনো সুখের ছোঁয়া পাইনি।
অতঃপর ঈমানদারদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তিকে হাজির করা হবে, যে ব্যক্তি দুনিয়ায় দুঃখ-কষ্ট ও বিপদাপদে জীবন কাটিয়েছে। বলা হবে, একে একটু জান্নাত দেখাও। অতঃপর তাকে জান্নাত দেখানো হবে। এরপর তাকে বলা হবে, হে অমুক! তোমাকে কি কখনো দুঃখ-কষ্ট স্পর্শ করেছে? সে বলবে, আমি কখনো দুঃখ-কষ্টে পতিত হইনি।’ (ইবনে মাজাহ: ৪৩২১)
হাদিসটি লক্ষ করুন, দুনিয়ায় দুঃখ-কষ্টে জীবনযাপন করা মানুষটি জান্নাতের সুখ-শান্তি দেখে সব দুঃখ ভুলে যাবেন, তাই তিনি দুনিয়ার দুঃখ-কষ্টকে অস্বীকার করবেন। অন্যদিকে, দুনিয়ায় আনন্দ-উল্লাসে থাকা অবিশ্বাসীর জাহান্নামের শাস্তি দেখে মনে হবে, সে কোনো সুখ-শান্তি দেখেনি।
কোরআন-হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী, জাহান্নামের শাস্তি যেমন কঠিন, তেমন জান্নাতের সুখ-শান্তিও অন্তহীন। জান্নাতিদের মৃত্যু নেই, রোগ-বালাই নেই, বার্ধক্য নেই; কেবল সুখ আর সুখ। জান্নাতের বর্ণনা দিতে গিয়ে রাসুল (স.) এক হাদিসে বলেন, ‘মহান আল্লাহ বলেছেন, আমি আমার নেককার বান্দাদের জন্য এমন জিনিস তৈরি করে রেখেছি, যা কোনো চক্ষু দেখেনি, কোনো কান শোনেনি এবং যার সম্পর্কে কোনো মানুষের মনে ধারণাও জন্মেনি। তোমরা চাইলে এ আয়াতটি পাঠ করতে পারো, ‘কেউ জানে না, তাদের জন্য তাদের চোখ শীতলকারী কী জিনিস লুকানো আছে।’ (সুরা সাজদাহ: ১৩; বুখারি: ৩২৪৪)
এ কারণে উম্মতদের সর্বদা দুনিয়ার মোহ ত্যাগ করে দুনিয়ায় সাদাসিধে জীবন যাপনের শিক্ষা দিয়েছেন প্রিয়নবীজি। আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন রাসুলুল্লাহ (স.) আমার কাঁধে হাত রাখলেন এবং বললেন, তুমি দুনিয়ায় এমনভাবে থাকো যেন তুমি একজন মুসাফির অথবা বিদেশি। ইবনে উমর (রা.) বলতেন, ‘যখন সন্ধ্যায় উপনীত হবে তখন তোমরা সকালের অপেক্ষা করো না। আর যখন সকাল হয় তখন সন্ধ্যার জন্য অপেক্ষা করো না। অসুস্থ হওয়ার আগে সুস্থতাকে কাজে লাগাও, আর তোমাদের মৃত্যুর জন্য জীবিতাবস্থায় পাথেয় জোগাড় করে নাও।’ (সহিহ বুখারি: ৬৪১৬)
দুনিয়ায় আল্লাহ তাআলা কাফের-মুশরিকদের প্রচুর ধন সম্পদ দিয়েছেন, নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব দিয়েছেন। তারাও পরকালের পরিবর্তে দুনিয়ার সুখ-শান্তিকে বেছে নিয়েছে। এসব দেখে মুমিনরা বিভ্রান্ত হতে পারেন না। কেননা তাদের ধন-সম্পদ, নেতৃত্ব, খ্যাতি সব দুনিয়ার জীবন পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। পরকালে তাদের জন্য কিছুই থাকবে না। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘এরা এমন লোক যাদের জন্য আখেরাতে আগুন ছাড়া অন্য কিছুই নেই এবং তারা যা করেছিল আখিরাতে তা নিষ্ফল হবে। আর তারা যা করত তা ছিল নিরর্থক।’ (সূরা হুদ: ১৬)
মোট কথা দুনিয়ার রঙে বেশামাল হওয়া মুমিনের কাজ নয়। বরং দুনিয়ার জীবনে দুঃখ-কষ্ট, বিপদ-মসিবত এলে পরকালীন নেয়ামতের কথা ভেবে সবর করতে হবে, তাওয়াক্কুল করতে হবে। তাছাড়া পরকাল যাদের সুন্দর, তাদের এমনিতেই দুনিয়ার জীবন রঙ্গিন হওয়ার কথা নয়। এজন্যই নবীজি (স.) ইরশাদ করেছেন— الدنيا سجن المؤمن وجنة الكافر ‘দুনিয়া মুমিনের জন্য জেলখানা এবং কাফেরের জন্য জান্নাত।’ (মেশকাত: ৪৯৩১) আসলে মুমিনদের জন্য ‘পার্থিব জীবন ধোঁকা ছাড়া অন্য কিছুই নয়।’ (সূরা আলে ইমরান: ১৮৬)
তাই দুনিয়ার ধোঁকা থেকে বেঁচে থাকা মুমিনের কর্তব্য। দুঃখ-কষ্ট-মসিবতে আল্লাহর সাহায্যের আশা করতে হবে; সবর করতে হবে। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে বিশুদ্ধ ঈমান ও নেক আমলের সঙ্গে জীবন পরিচালনা করার তাওফিক দান করুন। সৌভাগ্যবানদের অন্তর্ভুক্ত করুন। আমিন।