পবিত্র কোরআনের সুরা কাহাফে বেশ কয়েকটি বিস্ময়কর ঘটনার কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে একটি আসহাবে কাহাফ বা গুহাবাসীর ঘটনা। এই ঘটনার নামেই মূলত সুরাটির নাম রাখা হয়। পবিত্র কোরআনে এমন একদল যুবককে আসহাবে কাহাফ বলা হয়েছে, যারা একজন খোদাদ্রোহী অত্যাচারী শাসকের হাত থেকে বাঁচতে এবং নির্বিঘ্নে আল্লাহর ইবাদত করতে পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। আল্লাহ তাদের বিশেষ ব্যবস্থায় সুরক্ষা দেন এবং ৩০০ বছর পর্যন্ত তাদের ঘুমন্ত অবস্থায় রাখেন।
ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি কুকুরের বীরোচিত ভূমিকার কথাও পবিত্র কোরআনে আলোচিত হয়েছে। যেমন, এক আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তুমি মনে করবে—তারা সজাগ, অথচ তারা ছিল ঘুমন্ত, আমি তাদের ডানে-বামে পার্শ্ব পরিবর্তন করাতাম। আর তাদের কুকুরটি গুহার দরজার সামনে তার সামনের পা দুটি প্রসারিত করে ছিল। তুমি যদি তাদের দেখতে, তাহলে অবশ্যই পেছন ফিরে পালিয়ে যেতে, আর অবশ্যই আতঙ্কিত হয়ে পড়তে।’ (সুরা কাহাফ: ১৮)
এ আয়াত অনুযায়ী, আল্লাহ তাআলা গুহামুখের যে ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করেছিলেন, তাতে কুকুরের পা ছড়িয়ে বসে থাকা ছিল অন্যতম। এ কারণেই কোনো কোনো মুফাসসির জন্তুটিকে কুকুর না বলে বাঘ আখ্যা দিয়েছেন। কারণ, কোরআনে উল্লিখিত আরবি ‘কালব’ শব্দটি বাঘ অর্থেও ব্যবহৃত হয়। তবে অধিকাংশ মুফাসসির বলেছেন, সেটি কুকুরই ছিল; বাঘ ছিল না।
এরপর আসহাবে কাহফের সংখ্যার আলোচনায় আরও তিনবার কুকুরটির কথা এসেছে। যেমন, আল্লাহ তাআলা বলেছেন, কিছু লোক বলবে, তারা ছিল তিনজন, চতুর্থটি ছিল তাদের কুকুর। আর কিছু লোক বলবে, তারা ছিল পাঁচজন, ষষ্ঠটি ছিল তাদের কুকুর, অজানা বিষয়ে সন্দেহপূর্ণ অনুমানের ভিত্তিতে। আবার কিছু লোক বলবে, তারা ছিল সাতজন, আর অষ্টমটি ছিল তাদের কুকুর। বলো, তাদের সংখ্যা সম্পর্কে আমার প্রতিপালকই বেশি জানেন। অল্প কয়জন ছাড়া তাদের সংখ্যা সম্পর্কে কেউ জানে না। কাজেই সাধারণ কথাবার্তা ছাড়া তাদের ব্যাপার নিয়ে বিতর্ক করো না, আর তাদের সম্পর্কে কারও কাছে কিছু জিজ্ঞেসও করো না। (সুরা কাহাফ: ২২)
আসহাবে কাহাফের কুকুর সম্পর্কে মুফাসসিরদের বক্তব্য
কুকুরটির নাম ও গায়ের রং সম্পর্কে তাফসিরে বিভিন্ন বক্তব্য এসেছে। মুতাকিল বলেছেন, কুকুরটি ছিল হলুদ রঙের। কুরতুবি বলেছেন, হলুদে লালের মিশেল ছিল। কেউ বলেছেন, পাথরের রঙের ছিল। অধিকাংশ মুফাসসির কুকুরটির নাম ‘কিতমির’ বলেছেন। আলি (রা.) বলেছেন ‘রাইয়ান’। এ ছাড়া ‘তাকুর’, ‘সাহবা’, ‘কাতমুর’ ইত্যাদি নামও এসেছে।
কুকুরটি কীভাবে আসহাবে কাহফের সঙ্গে যুক্ত হলো এ বিষয়ে মুফাসসিরগণ বলেন, কুকুরটির মালিক ছিলেন একজন সাধারণ কৃষক। কেউ কেউ বলেছেন, সেকালের রাজার বাবুর্চি। কৃষক হোন বা বাবুর্চি—আসহাবে কাহফের সদস্যরা যখন পালিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন ওই লোকও তাদের সঙ্গে রওনা হন। কারণ তিনিও সত্য ধর্মের অনুসারী ছিলেন। ফলে কুকুরটিও তাদের পিছু নেয়। কোনো কোনো তাফসিরে কুকুরটির মানুষের মতো কথোপকথনের আলাপও এসেছে। যাই হোক, কুকুরটি যে আল্লাহর বিশেষ রহমত হিসেবে তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
আসহাবে কাহাফের কুকুর কি জান্নাতে যাবে?
কিছু তাফসির গ্রন্থে প্রখ্যাত তাবেয়ি খালেদ ইবনে মাদান (রহ.)-এর উদ্ধৃতি দিয়ে আসহাবে কাহফের কুকুর জান্নাতে যাবে বলা হয়েছে। তবে কোরআন-হাদিসে সরাসরি এ বিষয়টি উল্লেখ নেই। এ বিষয়ে কোনো সাহাবির বক্তব্যও সহিহ সনদে পাওয়া যায় না। এ ছাড়া বিষয়টি যেহেতু কোনো বিধানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়, তাই এ বিষয়ে নিশ্চিত করে কোনো কিছু বলা অনুচিত। বিশিষ্ট মুফাসসিররা বলেছেন, নির্ভরযোগ্য কোনো মারফু বা মাওকুফ রেওয়ায়েতে কুকুরটির জান্নাতে যাওয়ার বিষয়টি যেহেতু পাওয়া যায় না, তাই এগুলো বিশ্বাস করা ও বলা থেকে বিরত থাকা চাই। (দ্র. তাফসিরে রুহুল মাআনি: খ. ১৫ পৃ. ২২৬)
তবে আসহাবে কাহফের কুকুরটি যে সম্মানিত, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এই কুকুরের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন।
কুকুর পোষা কি জায়েজ?
আসহাবে কাহফের কুকুরকে মর্যাদা দেওয়া হলেও ইসলামে শখের বশে কুকুর পোষা বৈধ নয়। কারণ ইসলামে শখ করে কুকুর পালন করা নিষেধ। মহানবী (স.) বলেছেন, ‘যে ঘরে কুকুর আছে, সে ঘরে রহমতের ফেরেশতারা প্রবেশ করেন না।’ (বুখারি) তবে শিকার করা, ফসলের সুরক্ষা, পশুপাখির নিরাপত্তা, ঘরবাড়ি, দোকান ও অফিস পাহারা দেওয়া এবং অপরাধী চিহ্নিত করার জন্য কুকুর পোষা বৈধ। (মুসলিম, তিরমিজি, ফতোয়ায়ে আলমগিরি: ৪ / ২৪২)
মুফাসসিরগণ বলেন, আসহাবে কাহফের কুকুরকে মর্যাদাবান সাব্যস্ত করতে ইসলামের দৃষ্টিতে কোনো সমস্যা নেই। কারণ সেটি ছিল কৃষক বা বাবুর্চির সম্পদ সুরক্ষার জন্য পোষা কুকুর, যা ইসলামের দৃষ্টিতে অবৈধ নয়। কেউ কেউ বলেছেন, কুকুরটি আসহাবে কাহাফের সম্পদ সুরক্ষা ও নিরাপত্তার জন্য নিয়োজিত ছিল। ফলে তা শখের বশে পালিত কুকুর নয়। কোনো কোনো মুফাসসির বলেছেন, শখের বশে পালিত হলেও সমস্যা নেই। কারণ, তা ইসলামপূর্ব যুগের। তখন কুকুর পোষার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপিত হয়নি।