দরদি নবী ও মায়ার নবী হিসেবে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তুলনাহীন। উম্মতের প্রতি প্রিয় নবীর ভালোবাসা পরিমাপ করে শেষ করা যাবে না। আর প্রিয় নবী (সা.) গুনাহগার উম্মতকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষার চিন্তায় মগ্ন থাকতেন। উম্মতের জন্য তিনি এতটাই আবেগপ্রবণ ছিলেন যে, মহান আল্লাহর দরবারে তাদের মুক্তির জন্য কান্নাকাটি করতেন। এ প্রসঙ্গে সহিহ মুসলিমে আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রা.) বর্ণিত হাদিসে কুদসিতে এসেছে, তিনি বলেন, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) একদিন সমবেত সাহাবিদের সামনে মহান আল্লাহর একটি বাণী পাঠ করলেন, যাতে নিজ উম্মত সম্পর্কে হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর এই বক্তব্য উল্লেখ আছে, হে আমার পরওয়ারদিগার! এই মূর্তিগুলো অসংখ্য মানুষকে বিপথগামী করেছে। সুতরাং যে ব্যক্তি আমার অনুসরণ করবে কেবল সেই আমার দলভুক্ত। আর কেউ আমার কথা অমান্য করলে তুমি তো ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সুরা ইবরাহিম ৩৬)
তারপর নিজ উম্মত সম্পর্কে হজরত ঈসা (আ.)-এর এ বক্তব্য কোরআন থেকে পাঠ করলেন, ‘যদি তুমি তাদের শাস্তি দাও, তবে তারা তো তোমারই বান্দা। আর যদি তাদের ক্ষমা করে দাও তবে তাও তোমার অসাধ্য নয়। কারণ তুমি তো মহাপরাক্রমশালী, মহাজ্ঞানী। (সুরা মায়েদা ১১৮) এ দুটি আয়াত পাঠ করার পর রাসুলুল্লাহ (সা.) মহান আল্লাহর দরবারে দুটি হাত উত্তোলন করে বললেন, ‘হে আল্লাহ, আমার উম্মত! আমার উম্মত! এভাবে অনেকক্ষণ কান্নাকাটি করলেন। তখন মহান আল্লাহ জিবরাইল (আ.)-কে বললেন, হে জিবরাইল! মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে যাও। তাকে জিজ্ঞেস করো, সে কী কারণে কাঁদছে? অথচ মহান আল্লাহই সর্বাধিক জানেন, তিনি কেন কাঁদছেন। জিবরাইল (আ.) এসে তার কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলেন। নবী (সা.) তাকে সব কিছু জানালেন। অথচ আল্লাহ নিজেই সব কিছু জানেন। তখন মহান আল্লাহ বললেন, মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে ফিরে যাও। গিয়ে তাকে বলো, আমি অচিরেই তোমাকে তোমার উম্মতের ব্যাপারে সন্তুষ্ট করব। তোমার মনে ব্যথা দেব না।’ (সহিহ মুসলিম)
উম্মতের প্রতি প্রিয় নবী (সা.)-এর ভালোবাসা পরিমাপ করে শেষ করা যাবে না। যে কারণে মহান আল্লাহ আয়াত নাজিল করেছেন এভাবে, ‘নিশ্চয়ই তোমাদের নিজেদের মধ্য থেকে তোমাদের কাছে একজন রাসুল এসেছেন, (তোমাদের জন্য তার মায়া এতই বেশি যে) তোমাদের যা কিছু কষ্ট দেয় তা তার কাছে খুবই কষ্টদায়ক। তিনি তোমাদের কল্যাণকামী, মুমিনদের প্রতি স্নেহশীল, পরম দয়ালু।’ (সুরা তওবা ১২৮)
গুনাহের কাজের দিকে সাধারণত মানুষের ঝোঁক বেশি। কারণ গুনাহকে আকর্ষণীয় করা হয়েছে। এই আকর্ষণ থেকে বেঁচে থাকার মধ্যেই মানুষের কল্যাণ ও সফলতা নিহিত। অন্যথায় গুনাহের বোঝা নিয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করতে হবে। প্রিয় নবী (সা.) তার প্রিয় উম্মতকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার জন্য নেক আমলের শিক্ষা দিতেন এবং গুনাহের কাজ বর্জনের নসিহত করতেন। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণিত এক হাদিসে রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, আমার ও মানুষের উদাহরণ হলো ওই ব্যক্তির মতো, যে আগুন জ¦ালিয়েছে। আগুন চারপাশ আলোকিত করলে কীটপতঙ্গ এসে ভিড় জমাতে থাকে। পতঙ্গগুলো আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আর ওই লোক তাদের সেখান থেকে তুলে সরিয়ে ফেলে। আবার তারা সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তিনি তাদের সেখান থেকে উদ্ধার করেন। আমি তোমাদের জাহান্নামের আগুন থেকে বাধা দিই। আর মানুষ সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়ে। (সহিহ বুখারি)
রাসুলুল্লাহ (সা.) উম্মতের জন্য এতই ফলপ্রসূ চিন্তা করতেন যে, তাদের জন্য একটি দোয়া জমা রেখেছেন। যে দোয়া পরকালে করবেন। কারণ পরকালীন সফলতাই মানুষের আসল সফলতা, চিরস্থায়ী সফলতা। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুল (সা.) বলেছেন, সব নবীর এমন কিছু দোয়া আছে, যা আল্লাহর কাছে কবুল হয়। সব নবী দ্রুত নিজেদের জন্য দোয়া করেছে। আমি তা কেয়ামতের দিন উম্মতের সুপারিশের জন্য গোপন করে রেখেছি। আমার উম্মতের মধ্যে যে আল্লাহর সঙ্গে কোনো কিছু শরিক না করে মৃত্যুবরণ করবে, সে ইনশাআল্লাহ আমার সুপারিশ লাভ করবে। (সহিহ মুসলিম)
হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, এক রাতে রাসুল (সা.) বললেন, হে আয়েশা, আমাকে ছাড়ো। আমার রবের ইবাদত করব। আমি বললাম, আল্লাহর শপথ, আপনার সান্নিধ্যে থাকতে ভালোবাসি। আপনাকে আনন্দিত দেখতে পছন্দ করি। তিনি উঠে অজু করেন। অতঃপর নামাজ আদায় করেন। তখন কাঁদতে কাঁদতে তার কোল ভিজে যায়। তিনি তখন বসা। অশ্রুতে তার দাড়ি ভিজে যায়। এরপর জমিনও ভিজে যায়। বিলাল (রা.) এসে তাকে নামাজের জন্য ডাকেন। রাসুল (সা.)-কে কাঁদতে দেখে বললেন, হে আল্লাহর রাসুল, আপনি কেন কাঁদছেন? অথচ আল্লাহ আপনার পূর্বাপর সব গুনাহ ক্ষমা করেছেন। তখন তিনি বললেন, আমি কি একজন কৃতজ্ঞ বান্দা হব না? রাতে আমার ওপর এই আয়াত অবতীর্ণ হয়। কেউ তা পাঠের পরও চিন্তা না করলে তার জন্য ধ্বংস। আল্লাহ বলেন, ‘আসমান-জমিন সৃষ্টি ও দিন-রাতের আবর্তনে জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শন আছে।’ (সুরা আলে ইমরান ১৯০)
অন্যের কোরআন তেলাওয়াত শুনে রাসুল (সা.) কান্না করতেন। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) আমাকে বলেন, আমাকে কোরআন পড়ে শোনাও। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল, আপনার ওপর কোরআন অবতীর্ণ হয়। আমি আপনাকে কোরআন পড়ে শোনাব। তিনি বললেন, আমি অন্যদের কাছ থেকে কোরআন শুনতে পছন্দ করি। আমি সুরা নিসা পাঠ করি, ‘যখন আমি সব উম্মতের একজন সাক্ষী আনব এবং আপনাকে তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যদাতা হিসেবে আনব তখন কেমন হবে?’ (সুরা নিসা ৪১) এই আয়াত পাঠের পর আমি মাথা তুলে দেখি, তার দুচোখ অশ্রুসিক্ত। (সহিহ বুখারি)
কবর দেখলে রাসুল (সা.) কান্না করতেন। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) নিজ মায়ের কবর জিয়ারত করে কান্না করেন। আশপাশের সবাইও কান্না করে। অতঃপর তিনি বলেন, আমার রবের কাছে মায়ের জন্য ক্ষমা প্রার্থনার আবেদন করি। আমাকে অনুমতি দেওয়া হয়নি। তার কবর জিয়ারতের আবেদন করলে অনুমতি দেওয়া হয়। অতএব তোমরা কবর জিয়ারত করো। কেননা তা তোমাদের মৃত্যুর কথা স্মরণ করাবে। (সহিহ মুসলিম)
বারা ইবনে আজেব (রা.) বর্ণনা করেন, আমরা রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে ছিলাম। এমন সময় একটি দলকে দেখেন তিনি। তিনি বললেন, তারা কেন সমবেত হয়েছে? কেউ বলল, তারা কবর খুঁড়ছে। রাসুল (সা.) চিন্তিত মনে দ্রুত পায়ে গিয়ে কবরের দিকে ঝোঁকলেন। তিনি কী করেন তা দেখতে আমিও তার সামনে গেলাম। তিনি প্রচ- কান্না করেন। অশ্রুতে মাটি ভিজে যায়। অতঃপর আমাদের কাছে এসে বললেন, ভাইয়েরা, এ দিনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করো। (সুনানে ইবনে মাজাহ)
মুমিন মুসলমানের উচিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শ ও হুকুম-আহকাম বাস্তবায়নের মাধ্যমে এ ভালোবাসার প্রতিদান দেওয়া। কোরআন-সুন্নাহর ওপর আমল করা। রাসুলের ভালোবাসা অর্জন করা। মহান আল্লাহ মুসলিম উম্মাহকে প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শ অনুসরণ ও অনুকরণ করে সঠিক আশেকে রাসুল হওয়ার তওফিক দান করুন। আমিন।