সোনার পাথর বাটি বলে একটা কথা আছে। যার অর্থ দাঁড়ায় অসম্ভব ব্যাপার। ঠিক তেমনি দ্রব্যমূল্য, বাজার পরিস্থিতি নিয়ে সরকার যা বলে সেটাও যেন সোনার পাথর বাটি। সরকার আশ্বাস দেয় জনগণকে, আর সহায়তা করে ব্যবসায়ীদের ফলে যা হওয়ার তাই হয়। সরকার বলছে, মূল্যস্ফীতি, দ্রব্যমূল্য নিয়ে সব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে জনগণের স্বার্থে। আর জনগণ দেখছে প্রতিটি সরকারি পদক্ষেপের পর দ্রব্যমূল্য তো কমেই না, বরং ব্যবসায়ীদের দাম বাড়ানোর অজুহাত তৈরি হয়। যেমন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে ঋণের সুদের বৃদ্ধি করা হলো। বলা হচ্ছে, মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণ করতে বাজারে টাকার প্রবাহ কমানোর লক্ষ্যে সুদহার বাড়ানো হচ্ছে। কিন্তু এর ফলে উৎপাদন খরচ বাড়বে, বাড়বে পণ্যের দাম। ভুক্তভোগী শেষে সেই ভোক্তারাই। আর একটি উদাহরণ, গত ২১ মার্চ বেসরকারিভাবে চাল আমদানির অনুমোদন দিয়েছে সরকার। এর চারদিন পরেই সব ধরনের চালের দাম কেজিপ্রতি ২ টাকা থেকে ৪ টাকা বেড়ে গেল। অন্যদিকে বাস ভাড়া কমানো হলো প্রতি কিলোমিটারে তিন পয়সা। জনগণ এটাকে তামাশা এবং পরিবহন ব্যবসায়ীদের জন্য ‘ঈদ উপহার’ বলে মনে করেছে। কারণ উত্তরবঙ্গে যাবে যে বিপুল সংখ্যক মানুষ তাদের ভাড়া কমবে ৫ থেকে ৯ টাকা। অর্থাৎ ৩০০ কিলোমিটার দূরের যাত্রীর ভাড়া কমবে ৯ টাকা। অথচ ঈদ উপলক্ষে ভাড়া বাড়ানো হবে ২০০-৩০০ টাকা। বর্ধিত ভাড়ার সঙ্গে যুক্ত হবে সড়কপথের দুর্ভোগ। যারা ঈদে বাড়ি যান তাদের সিংহভাগ শ্রমজীবী মানুষ। ঈদের আগে বোনাস, বেতন পাওয়ার জন্য বিক্ষোভ করতে হয় তাদের। এবারও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে বকেয়া মজুরির জন্য বিক্ষোভ করছেন তারা।
দীর্ঘদিন ধরে সরকারের দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির ঘোষণা আর দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি সমান তালেই চলছে। রমজানে দাম বাড়ানো চলবে না এবং দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে থাকবে এই ঘোষণাও বাস্তবে অকার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। সাধারণ মানুষ এখন আশঙ্কায় আছে, ঈদযাত্রায় যানবাহনের ভাড়া ও ভোগান্তি নিয়ে। কেন ভোক্তারা আশা করে দ্রব্যমূল্য কমুক? কারণ দাম বাড়লে তার ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। যে মানুষের মাসিক আয় নির্দিষ্ট, সে চাইলেই তার আয় বাড়াতে পারে না। অথচ চাল, ডাল, তেল, মাছ, মাংস, লবণ, চিনি সবকিছুর দাম বেড়েছে এবং বাড়ছে। তখন সে কী করবে? সে সরকারকে দায়ী করে সরকার সাধারণ মানুষের জন্য কিছু করছে না বলে, আর নিজেকে দায়ী করে আয় বাড়াতে পারছে না বলে। কিন্তু ব্যবসায়ীকে বা বিক্রেতাকে কিছু বলতে পারে না, কারণ সে অসহায়। এর প্রভাব কি সমাজে পড়ে না? অবশ্য পড়লেই বা কী যায়-আসে, যারা ক্ষমতায় আছেন তাদের? তারা উদাহরণ দেন অতীতের, ইউরোপের এবং গালভরা বর্ণনা দেন নিজেদের কর্মতৎপরতার।
দেশের মানুষ ভালো আছে এ কথা প্রমাণ করতে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির হারের উল্লেখ করা হয়। এ ক্ষেত্রে সরকারি যে পরিসংখ্যান পাওয়া যায়, তা হলো মূল্যস্ফীতি ঘটেছে ৯ থেকে ১০ শতাংশের মধ্যে। কিন্তু বাজারে ক্রেতাদের কাছে তা কি বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়? একেবারেই না। কারণ গড় হিসাব করা হয় ৭২২টি পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ধরে আর সাধারণ মানুষ প্রতি মাসে বাজার থেকে যেসব পণ্য কিনে থাকে তা গড়ে ৬০টি। এগুলোর গড়ে দাম বেড়েছে ২০ শতাংশ। এই ৬০টির মধ্যে অনেক পণ্য আছে যেগুলোর দাম বেড়েছে ৫-১০ শতাংশ। আবার বাজারের তালিকায় এমন পণ্য আছে, যেগুলোর দাম বেড়েছে অত্যধিক, অর্থাৎ ৩০-৪০ শতাংশ। অর্থাৎ সাধারণ মানুষ যা বেশি ব্যবহার করে সেসব পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি গড়ের চেয়ে অনেক বেশি।
নানা অজুহাতে কয়েক মাস ধরেই বাজারে সব নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল নতুন উপলক্ষ রোজা। ফলে বাজারদর আরও আকাশচুম্বী। নিত্যপণ্যের সঙ্গে ইফতারির উপকরণের দাম বাড়ার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়েছেন নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভোক্তারা। অর্থনীতির চাহিদা জোগান তত্ত্ব না বুঝলেও মানুষ এটা ধরে নিয়েছে যে, সরকারের দুর্বল এবং ব্যবসায়ী সহায়ক ভূমিকার কারণে রমজান ঘিরে ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফার ইচ্ছায় লাগাম টানা যায়নি। এ জন্য সরকারের পক্ষ থেকে যতই হুমকি-ধমকি দিয়ে থাকুন না কেন, ব্যবসায়ীরা তাদের নিজস্ব ছকে নিয়ন্ত্রণ করেছে বাজার এবং বাড়িয়েছে দাম ও তাদের মুনাফা। গরুর মাংসের দাম নিয়ে নাটকের আড়ালে চাপা পড়ে গেছে অন্যান্য জিনিসের মূল্যবৃদ্ধির কথা।
যদিও সবসময় সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বলে থাকেন, সিন্ডিকেট বলে কিছু নেই। আসলে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী চক্র যারা সুযোগ পেলেই দাম বাড়িয়ে থাকে। এরা সরকারের উন্নয়নকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায়, বিরোধীদের সঙ্গে হাত মেলায় এবং বিরোধী দলগুলো তাদের সহায়তা করে। সঙ্গত কারণে প্রশ্ন উঠতেই পারে, এ ক্ষেত্রে সাধু ব্যবসায়ীদের ভূমিকা কী? আসলে পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে মুনাফাই প্রধান চালিকাশক্তি। এখানে ব্যক্তিগতভাবে সাধু-অসাধু হওয়া কোনো বিষয় নয়। ব্যাপারটা হচ্ছে, ব্যবসায়ীদের ক্ষমতা আর সরকারের আনুকূল্য। ফলে দু-একটা লোক দেখানো পদক্ষেপ নিলেও তেমন কার্যকর কোনো ব্যবস্থা কারও বিরুদ্ধে নেওয়া হয় না দেখে তারা বুঝতে পেরেছে, এসব হুমকি-ধমকিতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। বাজার চলবে ব্যবসায়ীদের ইচ্ছার গতিতে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা মনুষ্যসৃষ্ট দুর্ভোগ সবই তাদের দাম বাড়ানোর মওকা এনে দেয় বারবার এবং তার সদ্ব্যবহার করে তারা।
সামগ্রিক মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়ছে দরিদ্র, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের জীবনে। সাধারণ হিসেবে দেখা যায়, ৫ সদস্যের একটি পরিবারে মাসে ব্যয় বৃদ্ধি হচ্ছে প্রায় দুই হাজার টাকা। কোথা থেকে আসবে এই টাকা। তারা কি দুর্নীতি করবেন? চাইলেই কি সবাই দুর্নীতি করতে পারবেন? তাহলে উপায় কী? পথ একটাই, খরচ কমানো। বিবিএসের জরিপে দেখা যাচ্ছে, দেশের মানুষের চাল এবং ডিম খাওয়া কমেছে। রমজান উপলক্ষে খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে তাদের পাত থেকে আরও খানিকটা খাবার কমতে বাধ্য? রোজার অজুহাতে বাজারকে অস্থির করে সাধারণ মানুষের স্বস্তি কেড়ে নেওয়া তো চলছেই। সরকার সজাগ আছে, তৎপর আছে; এসব ঘোষণা মানুষ শুনেছে কিন্তু ঘোষণার ফল মানুষ দেখেনি, রমজান মাস পার হয়ে যাচ্ছে তবুও। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি নিয়ে এই দুঃসহ যন্ত্রণার মধ্যে চাপা পড়ে গেছে কৃষকের কান্না। বেগুন এক টাকা কেজিতেও বিক্রি করতে না পেরে গরুকে খাওয়ানো বা বাজারে বেগুন ফেলে আসা, লাউ ২ টাকায় বিক্রি করতে না পেরে কৃষকের হাহাকার আর শহরের বাজারে এত দাম কেন এই প্রশ্নের উত্তর মিলছে না কোথাও?
একে তো দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি জীবনকে বিপন্ন করছে, তার সঙ্গে যদি বিকল্পের নামে উদ্ভট পরামর্শ দেওয়া হয় তাতে মানুষ আরও হতবাক হয়ে পড়ে। একদিকে রাষ্ট্রের প্রধান মজুদদারদের সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলছে, এরা পণ্য পচিয়ে ফেলবে তবু সস্তায় বিক্রি করবে না। অন্যদিকে যাদের দায়িত্ব এসব মজুদদারদের ধরা বা নিয়ন্ত্রণ করা তারা বলছে, জনগণেরও কিছু দায়িত্ব আছে। জনগণের দায়িত্ব কী তাও তারা বলে দিয়েছে। প্রথম দায়িত্ব কম কেনা, কম খাওয়া। দ্বিতীয় দায়িত্ব, বিকল্প খুঁজে বের করা। আর তৃতীয় দায়িত্ব, দাম বাড়লেও খেতেই হবে এই মানসিকতা পরিহার করা। প্রয়োজনে খাবেন না, তারপর দেখুন দাম কমে কি না! মানুষের সামর্থ্য না থাকলে মানুষ খায় না, কেনে না এই নিয়মে তো মানুষ অভ্যস্ত। ফলে সেই পরামর্শ দেওয়ার জন্য ট্যাক্সের পয়সা খরচ করে মন্ত্রী, আমলার বেতন ভাতা দিতে হবে কেন? এই প্রশ্ন জনগণ করতে শুরু করেছে ইতিমধ্যেই। কিন্তু দাম না পাওয়া কৃষকের কাছে কী বিকল্প হাজির করবেন কর্তাব্যক্তিরা, তা অবশ্য শোনা হচ্ছে না। কারণ কৃষকরা কি কোনো গুরুত্ব বহন করে তাদের কাছে? কৃষকের এত কম দাম পাওয়া আর ভোক্তাদের বেশি দামে কেনার মাঝখানে যে টাকা সেটা যায় কাদের পকেটে, তা খুঁজে বের করা যাচ্ছে না কেন?
সন্তান-সন্ততি, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবসহ মানুষকে দেওয়া পরামর্শের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেওয়া হয় সম্ভবত কষ্ট সহ্য করার পরামর্শ। জীবনের দুঃখকে অনেক সময় অতিক্রম করা অসম্ভব বলে কৌতুক করে উড়িয়ে দেওয়ার উদাহরণ পৃথিবীর সব দেশে এবং সব ভাষাতেই আছে। সেই যে একটা কৌতুক আছে না! জীবন যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ যুবক গিয়েছে গুরুজনের কাছে সমাধানের আশায়। গুরুজন অভিজ্ঞ মানুষ। সব শুনে বললেন, কষ্ট করে কিছুদিন সহ্য কর বাবা! যুবক খুশিতে মুখটা উজ্জ্বল করে জানতে চাইল, তারপর আর দুঃখ থাকবে না বাবা? গুরুজন গভীর ধ্যানমগ্ন ভঙ্গিতে আশ্বাস দিয়ে বললেন, না রে বাবা, তখন দুঃখকে আর দুঃখ মনে হবে না। তোর সব সহ্য হয়ে যাবে। বাংলাদেশেও দ্রব্যমূল্য বাজার পরিস্থিতি নিয়ে এমন পরামর্শ দেওয়াটাই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ। কিন্তু বুদ্ধি দিয়ে, কথার মারপ্যাঁচে কি কষ্ট নিরাময় হয়? হয় না। জীবনের সংকটগুলো ঘনীভূত হয়। অসন্তোষ বাড়ে, বিক্ষোভের পটভূমি তৈরি হয়। অর্থনীতিতে তৈরি হয় নেতিবাচক প্রবণতা। দাম বেশি বলে কিনবে কম অথবা কিছু জিনিস কেনা বাদ দিলে খাদ্য পুষ্টির অভাব শুধু জীবনের গতি কমায় না, অর্থনীতির গতিকেও কমিয়ে দেয়। বাড়তে থাকে জনসাধারণের আক্ষেপ।
রমজান উপলক্ষে দাম বেড়েছিল খেজুরসহ ইফতার সামগ্রীর, ঈদ উপলক্ষে দাম বেড়েছে কাপড়চোপড়ের আর বাড়বে পরিবহনের ভাড়া। জনগণের ভোগান্তির শেষ নেই। তারপরও মানুষ ছুটবে নাড়ির টানে বাড়ির দিকে আর মুনাফা গুনবে ব্যবসায়ীরা। এ অবস্থা চলছে এবং প্রতি বছর চলবে। মানুষ ভাবছে কী আর করব, আনন্দকে কিনতে হবে কষ্টের দামে।