ইসরাইলের সামরিক বাহিনী দাবি করেছে তারা গাজার দক্ষিণাঞ্চলের প্রধান হাসপাতালে অভিযান চালিয়ে ‘কয়েক ডজন’ সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীকে আটক করেছে। সে সময় হাসপাতালের কর্মী এবং রোগীদের গোলাগুলির মুখে জোর করে পালিয়ে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। ইসরাইল বলছে, তারা খান ইউনিসের নাসের হাসপাতাল লক্ষ্য করে ‘সুনির্দিষ্ট ও সীমিত অভিযান’ পরিচালনা করেছে। তাদের কাছে গোয়েন্দা তথ্য ছিল যে, হামাস সেখানে জিম্মিদেরকে রেখেছে।
তবে এ অভিযোগকে ‘মিথ্যা’ উল্লেখ করে নাকচ করে দিয়েছে হামাস। হাসপাতালের পরিচালক বিবিসিকে বলেছেন, সেখানকার অবস্থা ‘বিপর্যয়কর এবং খুবই বিপজ্জনক’। ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রধান মুখপাত্র রিয়ার অ্যাডমিরাল ড্যানিয়েল হাগারি বলেন, যাদেরকে আটক করা হয়েছে তাদের মধ্যে গত সাত অক্টোবর ইসরাইলের ভেতরে হামাসের হামলায় অংশ নিয়েছিল এমন একজন রয়েছে। তিনি হামাসের ‘একজন অ্যাম্বুলেন্স চালক’ যিনি একজন জিম্মিকে গাড়ি চালিয়ে গাজায় নিয়ে গিয়েছিলেন এবং সশস্ত্র গোষ্ঠী পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব প্যালেস্টাইন গ্রুপ এর একজন সদস্য।
তবে হাসপাতালটিতে অভিযান চালিয়ে ইসরাইলি বিশেষ বাহিনী সেখানে জিম্মিদের থাকার বিষয়ে কোনো প্রমাণ পাননি এবং তল্লাশি এখনো অব্যাহত আছে। হাসপাতালের কিছু ছবি বিবিসি যাচাই করার কয়েক ঘণ্টা পর এমন মন্তব্য করেন তিনি। যাচাই করা ছবিতে দেখা যায়, চিকিৎসাকর্মীরা রোগীদের স্ট্রেচারে করে একটি ধোয়া বা ধুলা ভর্তি করিডর দিয়ে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। শয্যাশায়ী একজন রোগীকে ছাদ ধসে পড়া একটি করিডর দিয়ে সরিয়ে নিতে দেখা যাচ্ছে। আরো অনেক রোগীকে দেখা যাচ্ছে, যার মধ্যে একজন ব্যক্তিকে কম্বল দিয়ে জড়িয়ে সরিয়ে নিতে দেখা যাচ্ছে।
অন্য আরেকটি ভিডিও ক্লিপে দেখা যাচ্ছে, মানুষজন আসবাবপত্র এবং অন্যান্য জিনিসপত্র একটি দরজার সামনে এনে জড়ো করছে। আর একজন ইংরেজিতে বর্ণনা করছেন যে, ইসরাইলি বাহিনী প্রবেশ করতে যাচ্ছে। হাসপাতালের ভেতরে থাকা একজন নার্স বিবিসিকে বলেন, অভিযান চলার সময় হাসপাতালের ভেতরে ‘অনেকগুলো কুকুর ছেড়ে দেয়া হয়েছে।’ হাসপাতালের পরিচালক নাহিদ আবু-তেইমা বিবিসি অ্যারাবিককে বলেন, ‘হাসপাতাল ভবনের দৃষ্টিসীমার মধ্যে’ কয়েক ঘণ্টা ধরে ‘সহিংস গোলা নিক্ষেপ এবং মারাত্মক ধরনের বিস্ফোরণ’ ঘটানো হয়েছে।
তিনি বলেন, হাসপাতালে যে রোগীরা ছিলেন তাদেরকে ‘ওয়ার্ডে সারিবদ্ধ করে রাখা হয়েছিল’ যাদের মধ্যে অনেকের মারাত্মক ধরনের আহত রয়েছে। তিনি জাতিসংঘ এবং রেড ক্রসের কাছে রোগী এবং হাসপাতাল কর্মীদেরকে ‘রক্ষা’ করার আহ্বান জানিয়েছেন। গাজায় চালু রয়েছে এমন হাতেগোনা কয়েকটি হাসপাতালের মধ্যে নাসের হাসপাতাল একটি। এটি গত কয়েক দিন ধরে ইসরাইলের নিরাপত্তা বাহিনী এবং হামাসের মধ্যকার যুদ্ধের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে।
হাসপাতাল এলাকায় আশ্রয় নেয়া হাজার হাজার বাস্তুচ্যুত মানুষকে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়ার এক দিনের মাথায় বৃহস্পতিবার এই অভিযান চালালো আইডিএফ। বুধবার জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক দপ্তর জানিয়েছে, হাসপাতাল প্রাঙ্গণে স্নাইপার দিয়ে গুলি চালানো হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এর মাধ্যমে চিকিৎসক, রোগী এবং বাস্তুচ্যুত মানুষের জীবনকে হুমকির মুখে ফেলা হয়েছিল।
চিকিৎসা বিষয়ক দাতব্য সংস্থা মেডিসিন স্যান্স ফ্রন্টিয়ার্স জানায়, যাদেরকে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল তাদের সামনে যে পথ খোলা ছিল তা হচ্ছে- হয় হাসপাতালে থেকে যাও এবং “সম্ভাব্য টার্গেটে পরিণত হও” অথবা সরে যাও এবং বোমা বিস্ফোরণের “মহাবিপর্যয়কর পরিস্থিতির মধ্যে পড়ো।”
গত সাতই অক্টোবর ইসরাইলের সীমান্ত পাড় হয়ে ভেতরে গিয়ে হামাসের যোদ্ধারা হামলা চালানোর পর প্রতিরক্ষা অভিযান শুরু করে ইসরাইল। এই হামলায় ১২০০ জনকে হত্যা করা হয় যাদের মধ্যে বেশিরভাগই বেসামরিক নাগরিক। আর জিম্মি করে গাজায় নিয়ে আসা হয় ২৫৩ জনকে।
হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, ইসরাইলের হামলায় এখনো পর্যন্ত ২৮ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে যাদের মধ্যে বেশিরভাগই নারী ও শিশু। ইসরাইল বলছে, তাদের হামলার লক্ষ্য হচ্ছে হামাসকে নিশ্চিহ্ন করা এবং জিম্মিদের ফিরিয়ে আনা।
এদিকে, হামলা চালানো বন্ধ করতে আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক চাপের মুখে রয়েছে ইসরাইল। এরমধ্যে বুধবার ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখ্যোঁ ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে ফোন করে বলেছেন, গাজায় ইসরাইলের অভিযান ‘অবশ্যই বন্ধ করতে হবে’ কারণ গাজার এই অভিযানে যে পরিমাণ মানুষ নিহত হচ্ছে তা ‘সহ্য করার মতো নয়’। কিন্তু নেতানিয়াহু জানিয়েছেন তার সেনারা গাজার রাফাহ শহরের দিকে এগিয়ে যাবে যেখানে এরইমধ্যে বোমা নিক্ষেপ শুরু হয়েছে। রাফাহতে প্রায় ১৪ লাখের মতো ফিলিস্তিনি আশ্রয় নিয়েছে। অস্ট্রেলিয়া, কানাডা এবং নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীরা একটি যৌথ বিবৃতি দিয়েছে যেখানে তারা তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, গাজায় সামরিক অভিযান চালানো হলে তা হবে ‘বিপর্যয়কর’। সূত্র: বিবিসি।
বিভাগ : আন্তর্জাতিক