মিয়ানমারের মংডু থেকে ছোট ছোট ট্রলারে টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে গতকাল শনিবার বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করে অনেক রোহিঙ্গা। তবে একজন রোহিঙ্গাও যাতে সীমান্ত ডিঙাতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে বিজিবি ও কোস্টগার্ড। কয়েক দিনে শতাধিক রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঠেকিয়েছে বিজিবি।
এদিকে, গতকাল ভোরেও বান্দরবানের তুমব্রু ও টেকনাফের বিভিন্ন এলাকায় মিয়ানমার অংশে থেমে থেমে বিকট গোলাগুলির শব্দ পাওয়া গেছে। বান্দরবানের উত্তরপাড়া এবং টেকনাফের হোয়াইক্যংয়ের লম্বাবিল, উনচিপ্রাং, কানজরপাড়া সীমান্তের নাফ নদের ওপারে গুলি, মর্টার শেল বিস্ফোরণের বিকট শব্দে বারবার কেঁপে ওঠে। হোয়াইক্যং বাজার থেকে আধা কিলোমিটার পূর্বে উত্তরপাড়া। হোয়াইক্যং সীমান্তের বাসিন্দা মো. সাইফুল বলেন, ভোর ৫টা থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত ওপার থেকে গোলাগুলির শব্দে এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় ওপার থেকে কিছু লোকজন এপারে ঢোকার চেষ্টা করেছিল। বিজিবির সতর্ক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশে ঢুকতে না পেরে তারা চলে যায়।
হোয়াইক্যং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নুর আহমেদ আনোয়ারী বলেন, সীমান্তে মিয়ানমারে মর্টার শেলের মতো বিকট গোলাগুলির শব্দ শোনা গেছে। সীমান্ত দিয়ে লোকজন যাতে অনুপ্রবেশ করতে না পারে, সে জন্য আমরাও সতর্ক রয়েছি। গোলাগুলিতে এপারে কেউ হতাহত হয়নি। বৃষ্টির মতো গুলির কারণে অনেক বাসিন্দা বসতভিটা ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কারও মাছের ঘের, দোকান ও বসতবাড়িতে গুলি পড়ছে। ভাগ্য ভালো কেউ প্রাণ হারাননি।
বিজিবির কক্সবাজার ব্যাটালিয়নের পরিচালক (অপারেশন্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল হাফিজুর রহমান বলেন, আগের চেয়ে সীমান্তে গোলাগুলি কমেছে। বিজিবির টেকনাফ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মহিউদ্দীন আহমেদ বলেন, শতাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করেছিল। আমরা নতুন করে কাউকে ঢুকতে দিচ্ছি না।
এদিকে কক্সবাজারের উখিয়ার পালংখালী সীমান্তে পড়ে থাকা লাশ শনিবার দুপুর দেড়টার দিকে উদ্ধার করা হয়েছে। তিন দিন ধরে সীমান্তের জিরো লাইনের কাছাকাছি ওই লাশ পড়ে ছিল। কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মাহফুজুল ইসলাম বলেন, লাশের পরিচয় এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। প্রাথমিক ধারণা, লাশটি কোনো রোহিঙ্গার হতে পারে। ময়নাতদন্তের জন্য মরদেহ কক্সবাজার সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
টেকনাফে কোস্টগার্ডের লে. কমান্ডার এইচ এম লুৎফুল লাহিল মাজিদ বলেন, ২৫ জানুয়ারি থেকে কোস্টগার্ড টেকনাফ এলাকায় সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। এখন পর্যন্ত বিভিন্ন দফায় বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করেছে এমন ১০৪ রোহিঙ্গাকে ঢুকতে দেয়নি কোস্টগার্ড।
এদিকে, গতকাল নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম সীমান্ত এলাকা থেকে দুটি গোলা উদ্ধার করা হয়েছে। স্থানীয়রা মর্টার শেল বললেও তা মূলত আরপিজি বা রকেট প্রপেলড গ্রেনেড। আরপিজিগুলো নিয়ে কয়েকটি শিশুকে খেলতে দেখে সেগুলো বাড়িতে নিয়ে যান এক নারী। পরে ওই গোলা বিজিবির কাছে দেওয়া হয়েছে।
ঘুমধুমের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ জানান, নতুন করে পাওয়া দুটি মর্টার শেল (আরপিজি) লাল পতাকা দিয়ে ঘিরে রেখেছে বিজিবি। ক্ষেতখামার, কৃষিজমিতে মিয়ানমারের এসব গোলা পাওয়া যাচ্ছে। অবিস্ফোরিত এসব গোলা সীমান্তের বাসিন্দা ও শিশুরা অনেক সময় না বুঝেই ধরছে, নিয়ে খেলাধুলাও করছে। এতে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে।
গতকাল ভোরে আরপিজি দেখতে পান স্থানীয় বাসিন্দা রিজিয়া। তিনি বলেন, জমিতে কাজ করছিলাম। এ সময় দেখলাম লম্বা লোহার রডের মতো কোনো একটা জিনিস নিয়ে শিশুরা খেলছে। শিশুদের কাছ থেকে সেটি নিয়ে বাসায় আনার পর স্বামীর কাছে জানলাম, এটি ভয়ংকর অস্ত্র।
ফেরত পাঠানোর রুটম্যাপ আজ চূড়ান্ত
মিয়ানমারের রাখাইনে বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সঙ্গে জান্তা সরকারের সংঘাতের পর দেশটির সেনা, সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্য বিজিপি, শুল্ক কর্মকর্তাসহ ৩৩০ জন বাংলাদেশে ঢুকে পড়েন। নিরস্ত্র করে তাদের বিজিবি হেফাজতে রাখা হয়েছে। সমুদ্রপথে কীভাবে তাদের মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়, সে ব্যাপারে রুটম্যাপ আজ চূড়ান্ত হতে পারে। দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, আজ রোববার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এ-সংক্রান্ত একটি সভা রয়েছে। মিয়ানমারের জাহাজ জলসীমানার কতটুকু পর্যন্ত এসে ৩৩০ জনকে ফিরিয়ে নেবে, সেটা ঠিক হবে আজ। বাংলাদেশের জাহাজে তাদের উঠিয়ে মিয়ানমারের জাহাজে তুলে দেওয়া হবে, নাকি মিয়ানমারের জাহাজ বাংলাদেশের কোনো জেটিঘাট পর্যন্ত সরাসরি তাদের নিয়ে যাবে, সেটা এখনও চূড়ান্ত হয়নি।
কান্না থামছে না কৃষক আনোয়ারুলের পরিবারের
কক্সবাজারের উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের রহমতের বিলে মঙ্গলবার কৃষক আনোয়ারুল ইসলামকে গুলি করা হয়। স্থানীয়রা জানান, ওই দিন কয়েকজন অস্ত্রধারী ঢোকার সময় আনোয়ারুল তাদের পরিচয় জানতে চান। এরপরই তাঁর ওপর হামলা হয়। হতদরিদ্র আনোয়ারুলের স্ত্রী মরিয়ম বেগম জানান, তাঁর স্বামীর অবস্থা সংকটাপন্ন। অস্ত্রোপচার করে পেট থেকে গুলি বের করা হয়েছে। তিন সন্তান নিয়ে কীভাবে সংসারের খরচ চালাবেন, তা নিয়ে চিন্তিত মরিয়ম। চিকিৎসার খরচ জোগাতেও হিমশিম খাচ্ছে পরিবার। আনোয়ারুলের বড় মেয়ে আয়েশার ভাষ্য, বাবার এমন পরিণতি হবে কল্পনাও করিনি। আমরা খুব কষ্টে আছি। বাবা আবার কাজ করতে পারবে কিনা, জানি না।
রিমান্ড চায় পুলিশ
মিয়ানমারে সংঘাতের মধ্যে বাংলাদেশে অস্ত্রসহ প্রবেশ করা ২৩ রোহিঙ্গাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে চায় পুলিশ। শুক্রবার দুপুরে উখিয়া থানায় বিজিবির এক সদস্য বাদী হয়ে ওই রোহিঙ্গাদের আসামি করে মামলা করেন। এরপর তাদের পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। উখিয়া থানার ওসি মো. শামীম হোসেন বলেন, শনিবার দুপুরে তাদের কক্সবাজার আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করার পর স্থানীয় জনতা তাদের আটক করে বিজিবির কাছে সোপর্দ করে।