কানাডার ‘বেগমপাড়া’ এবং মালয়েশিয়ার ‘মাই সেকেন্ড হোম’ কর্মসূচি মাঝে মাঝেই বাংলাদেশের মিডিয়ায় আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। মঙ্গলবার সমকালের এক প্রতিবেদনের দৌলতে বেগমপাড়া না হলেও মাই সেকেন্ড হোম আবারও আলোচনায় উঠে এসেছে। সেখানে বলা হয়েছে, কর্মসূচিটি চালু হওয়ার পর থেকে আজ অবধি বাংলাদেশ থেকে অন্তত পাঁচ হাজার মানুষ মালয়েশিয়া সরকারের তথা ‘আমার দ্বিতীয় নিবাস’ কর্মসূচির সুবিধা গ্রহণ করেছেন এবং এর আওতাধীন বাংলাদেশিরা বাংলাদেশের চেয়ে সব দিক থেকেই অনেক অগ্রসর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এ দেশটিতে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট ও বাড়ি ক্রয় করে বেশ আয়েশে দিন কাটান।
বলা হয়ে থাকে, কানাডার বেগমপাড়ায় মূলত সেই নারীরা একা বা সন্তানাদি নিয়ে বসবাস করেন, যাদের স্বামীরা বাংলাদেশে থাকেন রাজনীতি, ব্যবসা বা চাকরির সুবাদে। এখানে স্বামীরা বৈধ বা অবৈধ উপায়ে যে টাকা উপার্জন করেন, তা অবৈধ পথে চলে যায় কানাডায়– তাদের বেগম বা স্ত্রীদের কাছে, পরিবারের প্রবাসী সদস্যদের ভরণপোষণের জন্য। উপার্জিত টাকাটা বৈধ হলেও কানাডা বা দেশের বাইরে অবৈধ পথে পাঠাতে হয়। কারণ এ দেশের আইনে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি ছাড়া কেউ বাইরে টাকা পাঠাতে বা নিয়ে যেতে পারেন না। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক কাউকে যতটুকু টাকা বাইরে নেওয়ার অনুমতি দেয়, তা দিয়ে ওই বিদেশ বিভূঁইয়ে অন্তত বাড়ি কেনা বা ব্যবসায় বিনিয়োগ চলে না।
মালয়েশিয়ায় অবশ্য এ দেশের যারা বাড়ি বা ফ্ল্যাট কিনেছেন, তারা কানাডার মতো সেখানে স্ত্রী-সন্তানদের ছেড়ে আসেন না। মূলত ভবিষ্যতে দেশে কোনো জুট-ঝামেলায় পড়লে ‘নিরাপদ’ আবাসন হিসেবে ব্যবহার বা মাঝে মাঝে ছুটি কাটাতে গিয়ে ঝামেলাবিহীন সময় কাটানোর জন্য তাদের এ আয়োজন। এক সময় এ মানুষেরাই ঢাকার পাশে গাজীপুর বা অন্য কোনো নিরিবিলি শহরে বাগানবাড়ি বানাতেন। সেসব শহর ইতোমধ্যে মুখ্যত অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে ঘিঞ্জি হয়ে উঠেছে। তাই ‘হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোনোখানে’ ঠাঁই খুঁজতে গিয়ে তারা মালয়েশিয়া বা অন্য কোনো দেশের দ্বিতীয় নিবাস কর্মসূচির সুবিধা নিয়েছেন। অবশ্য ইতোমধ্যে এই শ্রেণির মানুষের প্রভাব-প্রতিপত্তিও এতটাই বেড়েছে যে, তার সুবাদে একদিকে পকেট যেমন ফুলেফেঁপে উঠেছে, তেমনি নানা কারণে নিরাপত্তাহীনতাও তৈরি হয়েছে। তাই বিদেশ বিভূঁই-ই একমাত্র নিরাপদ আশ্রয়।
প্রতিবেদন মতে, মালয়েশিয়ার দ্বিতীয় নিবাস কর্মসূচির আওতায় কেবল নিবন্ধিত হতেই একজন বাংলাদেশিকে মালয়েশিয়া ব্যাংকে ছয় লাখ রিঙ্গিত (দেড় কোটি টাকা) ফিক্সড ডিপোজিট রাখতে হয়। উপরন্তু সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মাসিক আয় দেখাতে হয় ১০ হাজার রিঙ্গিত (আড়াই লাখ টাকা)। তবে আবেদনকারীর বয়স ৫০ বছরের নিচে হলে উভয় খাতেই দ্বিগুণ অর্থ গুনতে হয়। এর সঙ্গে বাড়ি বা ফ্ল্যাট কেনার খরচ যুক্ত হলে টাকার হিসাবটা আর সহজ থাকে না। তবে ওখানে যারা বাড়ি কেনেন, তাদের তো আর যে কোনো একটা ঠাঁই হলেই চলে না; এ দেশের নব্য অভিজাত শ্রেণিভুক্ত যে তারা! তাই যে সে ফ্ল্যাট নয়, রীতিমতো কনডোমিনিয়াম– এক কম্পাউন্ডেই জীবনের প্রায় সব আয়োজন।
মালয়েশিয়ায় নাকি ইতোমধ্যে বাংলাদেশি অধ্যুষিত বেশ কয়েকটি এলাকাও গড়ে উঠেছে। প্রতিবেদন অনুসারে, সেখানকার বাংলা মার্কেট ও শাহ আলী এলাকায় সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি বাস করেন। কুয়ালালামপুরে বড় বড় কনডোমিনিয়ামে বাংলাদেশিরা বাংলো কিনে আধুনিক ইন্টেরিয়র ডিজাইনে সাজিয়েছেন, পাশেই সাইবারজায়া ও ফেডারেল সরকারের রাজধানী পুত্রজায়াতে দেখা মেলে এ ধরনের একাধিক বিলাসবহুল ডুপ্লেক্স কনডোমিনিয়ামের– যেখানে কাজ করেন বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালের শ্রমিকরা। বিস্ময়কর হলেও সত্য, বাংলাদেশি কর্তাব্যক্তিদের কাছে মালয়েশিয়া ইতোমধ্যে ঘরের আঙিনা হয়ে উঠলেও এসব তাদের চোখে পড়ে না।
মনে আছে নিশ্চয়ই, বিশ্বব্যাপী আলোড়ন তোলা ‘পানামা পেপারস’, ‘প্যারাডাইস পেপারস’ ইত্যাদি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এ দেশের কিছু ব্যক্তির নাম আসায় ২০২১ সালে উচ্চ আদালত দুদককে কিছু ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছিলেন। কিন্তু দুদক এ বিষয়ে সন্দেহভাজন বাংলাদেশিদের একটা তালিকা আদালতে জমা দিয়ে তার দায়িত্ব শেষ করে। বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট– বিএফআইইউ, অর্থ পাচার নিয়ে কাজ করাই যার প্রধান কাজ, তাকেও আদালত পরবর্তী সময়ে কিছু দায়িত্ব দেন। কিন্তু সংস্থাটিও পাচারকৃত অর্থ ফেরাতে সিঙ্গাপুর, কানাডা, মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাত, অস্ট্রেলিয়া, হংকং ও থাইল্যান্ড– এ দশ দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরের তাগিদ দিয়েই ক্ষান্ত হয়।
সদ্য বিদায়ী অর্থমন্ত্রীকেও একবার সাংবাদিকরা অর্থ পাচার নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন। মন্ত্রী উত্তরে বলেছিলেন, তিনি কোনো অর্থ পাচার দেখতে পাচ্ছেন না; তিনি বরং সাংবাদিকদের বলেছিলেন, তারা যদি এমন কিছু বের করেন, তাঁকে জানান তিনি ব্যবস্থা নেবেন।
এ কর্তাব্যক্তিদের কোনো হেলদোল না থাকলেও অর্থ পাচার কিন্তু ঘুণপোকার মতো অর্থনীতিকে খেয়েই চলছে। কে না জানে, এ অর্থ পাচারের প্রধান উপায় হুন্ডি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কুয়ালালামপুরের ব্যাংক, মানি ট্রান্সফার, মানি এক্সচেঞ্জ, রেমিট্যান্স হাউসে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হুন্ডি ব্যবসায়ীরা ঘরে বসে, আবার কিছু কিছু এলাকায় প্রকাশ্যে অফিস খুলে নির্বিঘ্নে ব্যবসা চালাচ্ছে। এভাবে সেখানকার বাংলাদেশি শ্রমিকদের কষ্টার্জিত রিঙ্গিত মালয়েশিয়াতেই থেকে যায়, হাত বদল হয়ে বাংলাদেশি বাড়ি ক্রেতাদের এজেন্টদের মাধ্যমে। দেশ হারাচ্ছে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা, কমছে রিজার্ভ, উদ্বেগ বাড়ছে এখানকার আমজনতার মধ্যে অর্থনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে।
হুন্ডি ব্যবসায়ীদের বিষয়ে মালয়েশিয়া সরকারের কোনো অভিযান থাকার কথা না। কারণ তারা এতে লাভবানই হচ্ছে। আমাদের সরকার চাইলে মালয়েশীয় সরকারের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলতে পারে। বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া জাতিসংঘের দুর্নীতিবিরোধী কনভেনশনে সই করেছে। এর আওতায় তথ্য চাওয়ার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু তার কোনো লক্ষণ আপাতত দেখা যাচ্ছে না।
তবে দেশটা তো আমাদের– সাধারণ জনগণের। তাই অর্থ পাচারের মতো দেশ ও অর্থনীতিবিধ্বংসী তৎপরতা বন্ধে সজাগ ও সক্রিয় না হয়ে কি উপায় আছে?