লাওসে আসিয়ান পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের শীর্ষ সম্মেলনে মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধ এবং দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি নিয়ে সৃষ্ট উত্তেজনা প্রধান এজেন্ডা হয়ে দেখা দেয়। এ দুটি কণ্টকিত ইস্যু এ বছরেই অগ্রগতি হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন লাওসের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালেউমক্সে কোম্মাসিথ। এ খবর দিয়েছে অনলাইন দ্য ডিপ্লোম্যাট। সোমবার এই সম্মেলনের দিন সাংবাদিকদের কাছে কোম্মাসিথ বলেন, মিয়ানমারে মানবিক সহায়তা দেয়ার পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে থাইল্যান্ড। দেশটিতে গৃহযুদ্ধে কমপক্ষে ২৬ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত। তিনি আরও বলেছেন, ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেনা কর্মকর্তারা ক্ষমতা দখল করে। তারপর এবারই প্রথমবারের মতো আসিয়ান পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের মিটিংয়ে উচ্চ পর্যায়ের একজন প্রতিনিধি পাঠিয়েছে মিয়ানমারের সেনা কর্মকর্তারা। লাওসের ঐতিহাসিক শহর লুয়াং প্রবাংয়ে এই সম্মেলন হয়। সালেউমক্সে কোম্মাসিথ বলেন, আমরা কিছুটা আশাবাদী যে এসব ইস্যুতে কিছুটা অগ্রগতি হতে পারে। তবে মিয়ানমারে যা ঘটছে তা রাতারাতি সমাধান করা যাবে না।
আমার মনে হয়, সুড়ঙ্গের অন্যপ্রান্তে মিটমিট করে জ্বলা আলো দেখা যাচ্ছে।
উল্লেখ্য, ২০২১ সালে অং সান সুচির সঙ্গে আসিয়ানের একজন দূতকে সাক্ষাৎ করতে দেয়নি মিয়ানমারের সামরিক জান্তা। তারপর থেকে আসিয়ানের উচ্চ পর্যায়ের কোনো মিটিংয়ে মিয়ানমারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বা অন্য কোনো রাজনৈতিক প্রতিনিধি পাঠানোর বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে আসিয়ান। এর প্রেক্ষিতে এবারকার মিটিংয়ে তারা পাঠিয়েছে একজন অরাজনৈতিক প্রতিনিধি। তিনি আসিয়ান পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের মিটিংয়ে উচ্চ পর্যায়ে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেননি। লাওসে পাঠানো ওই ব্যক্তি হলেন মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সরকারি কর্মকর্তা, আসিয়ানের স্থায়ী সচিব মারলার থান হতিকে। তাকে এই মিটিংয়ে পাঠানোকে ইতিবাচক লক্ষণ বলে মনে করছেন সালেউমক্সে কোম্মাসিথ।
আসিয়ানের সদস্য দেশগুলো হলো- ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার, কম্বোডিয়া, ব্রুনেই এবং লাওস। এ দেশগুলো মিলে মোট জনসংখ্যা প্রায় ৬৫ কোটি। তাদের আছে কমপক্ষে ৩ ট্রিলিয়ন ডলারের জিডিপি। পর্যায়ক্রমিক হিসাবে এ বছর আসিয়ানের নেতৃত্ব দিচ্ছে লাওস। এ দেশটি ভূমিবেষ্টিত। এই ব্লকের এটিই সবচেয়ে দরিদ্র দেশ এবং সবচেয়ে ছোট দেশের অন্যতম। যখন আসিয়ানের ভিতরে পাহাড়সম সমস্যা বিরাজ করছে, তখন তারা তা সমাধানে আশাবাদ ব্যক্ত করেছে। আসিয়ানের মধ্যে এটিই প্রথম দেশ, যাদের সঙ্গে মিয়ানমারের অভিন্ন সীমান্ত আছে। মিয়ানমারে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখলের পর এবারই প্রথম এ দেশটি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছে। এরই মধ্যে যারা চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছে, তাদের থেকে তারা নতুন কিছু দেখানোর আশা করছে।
এরই মধ্যে মিয়ামনারের সামরিক কাউন্সিল ও অন্য শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য একজন বিশেষ দূতকে মিয়ানমারে পাঠিয়েছে লাওস। এর উদ্দেশ্য, এর আগে শান্তি পরিকল্পনায় আসিয়ান মিয়ানমারকে যে ‘৫ দফা সম্মতি’ পরিকল্পনা দিয়েছিল, তাতে অগ্রগতি করা। ওই পরিকল্পনার অন্যতম হলো ১. অবিলম্বে মিয়ানমারে সহিংসতা বন্ধ করতে হবে। ২. সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে নিয়ে সংলাপ করতে হবে। ৩. এতে মধ্যস্থতা করবেন আসিয়ানের একজন বিশেষ দূত। ৪. আসিয়ানের চ্যানেলের মাধ্যমে মানবিক সহায়তা দেয়ার বিধান থাকবে এবং ৫. সংশ্লিষ্ট সব দলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে মিয়ানমার সফর করবেন বিশেষ দূত। কিন্তু এই পরিকল্পনা এখন পর্যন্ত উপেক্ষা করে আসছে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা। এর ফলে খুবই দ্রুতগতিতে মিয়ানমারে বৃদ্ধি পাচ্ছে সহিংসতা ও মানাবিক সংকট।
মিটিংয়ের পর সাংবাদিকদের কাছে সিঙ্গাপুরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভিভিয়ান বালাকৃষ্ণান বলেন, আবার মিটিংয়ে মিয়ানমারের একজন প্রতিনিধি থাকাটা সহায়ক হয়েছে। তবে মিয়ানমার যে ওই ৫ দফা পরিকল্পনা মেনে নেবে এ বিষয়ে তিনি আশাবাদী এমনটা মনে করেন না। তিনি বলেন, যদি আপনি অতীতের রেফারেন্স নেন, তাহলে দেখবেন তা ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটাতে খুব বেশি সময় নিয়েছে। অবাস্তবভাবে আমি আশা করবো না। তবে সালেউমক্সে কোম্মাসিথ বলেন, ওই পরিকল্পনা পুরোপুরি বাস্তবায়নের জন্য অব্যাহতভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাবে আসিয়ান। একই সঙ্গে বাড়ানো হচ্ছে মানবিক সমর্থন।
আসিয়ান দেশগুলোতে অন্যতম কমিউনিস্ট দেশ লাওস। চীনের সঙ্গে তাদের আছে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। তবে অনেকে মনে করেন, প্রতিবেশী মিয়ানমারের সমস্যা সমাধানে তারা সহায়তা করতে পারে। কারণ, মিয়ানমারে বড় ধরনের প্রভাব আছে বেইজিংয়ের। তবে চীন বলেছে, অন্য দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না। তাদের এমন ভূমিকা অন্য আসিয়ান সদস্যদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে কিনা তাও অস্পষ্ট। দক্ষিণ চীন সাগরকে কেন্দ্র করে চীনের সঙ্গে সামুদ্রিক বিরোধে দীর্ঘদিন জড়িয়ে আছে আসিয়ানের সদস্য ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া এবং ব্রুনেই। এই সমুদ্রপথকে বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পানিপথের অন্যতম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। প্রতি বছর এই সমুদ্রপথ দিয়ে প্রায় ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক পণ্য চলাচল করে। ফলে সেখানে সরাসরি সংঘাতে লিপ্ত হয়েছে চীন। বিশেষ করে ফিলিপাইন এবং ভিয়েতনামের সঙ্গে সেই সংঘাতময় পরিস্থিতি জোরালো। ভিয়েতনামে সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে সোমবারই মিটিং করেন ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট ফার্দিনান্দ মারকোস জুনিয়র। সেই মিটিংয়ে অন্য ইস্যুর সঙ্গে ছিল দক্ষিণ চীন সাগরে চলমান উত্তেজনার ইস্যু। এই ইস্যুতে চীনের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা, শত্রুতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে আসিয়ানের অন্য সদস্যদের সহায়তা চায় ফিলিপাইন। অনেকেই মনে করেন এই উত্তেজনায় জড়িয়ে পড়তে পারে ম্যানিলার দীর্ঘদিনের মিত্র ওয়াশিংটন। এরই মধ্যে চীনের কোস্ট গার্ডদের ওয়াটার ক্যাননসহ সামরিক সরঞ্জাম ব্যবহারের বিরুদ্ধে চীনের কাছে প্রতিবাদ জানিয়েছে ফিলিপাইন। ২০০২ এবং ২০১২ সালে চীন এবং আসিয়ান দক্ষিণ চীন সাগরে উত্তেজনা প্রশমনে একমত হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তা মেনে চলার ক্ষেত্রে খুব কমই লক্ষণ দেখা গেছে।