গত ১২ জানুয়ারি ইয়েমেনে হুতিদের ওপর হামলা চালায় যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র। এ হামলা ছিল লোহিত সাগরে বাণিজ্যিক জাহাজের ওপর হুতিদের আক্রমণের একটি প্রতিক্রিয়া। হুতিদের আক্রমণ বৈশ্বিক বাণিজ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। আবার হুতিদের আক্রমণ শুরু হয় যখন; ২ জানুয়ারি লেবাননের বৈরুতে হামাস নেতা সালেহ আল-আরোরিসহ অন্যদের হত্যা করে ইসরায়েল। হিজবুল্লাহর কমান্ডার হাসান নাসরাল্লাহ হামাস নেতা খুনের প্রতিশোধ নেওয়ার অঙ্গীকার করে ঘোষণা করেন– ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ‘প্রতিরোধ অক্ষ’ সবকিছু করবে।
নাসরাল্লাহর কথা দিয়ে চটকদার ভিডিও তৈরি করে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এর পর অক্ষশক্তির আক্রমণ শুরু হয়। হিজবুল্লাহ ইসরায়েলের মেরন বিমান নিয়ন্ত্রণ ঘাঁটিতে ৬২টি রকেট হামলা চালায়; ইরাকভিত্তিক ইসলামী প্রতিরোধ গ্রুপ সিরিয়া ও ইরাকের মার্কিন ঘাঁটি আক্রমণ করার জন্য ড্রোন পাঠায় এবং ইসরায়েলি শহর হাইফায় দূরপাল্লার ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। অন্যদিকে হুতিরা লোহিত সাগরে আঘাত হানে এবং ইরান ওমান উপসাগরে তেলের ট্যাঙ্কার দখল করে।
পশ্চিমা ও আঞ্চলিক দেশগুলো দাবি করেছিল, তারা গাজা যুদ্ধকে আঞ্চলিক সংঘাতে রূপান্তর হতে দিতে চায় না। তবে ইরান, হিজবুল্লাহ, হুতি ও অক্ষশক্তির অন্য সদস্যরা ভিন্ন খেলা খেলছে। তারা আঞ্চলিক যুদ্ধ মোকাবিলায় ধৈর্যের সঙ্গে এবং পদ্ধতিগতভাবে তাদের জোট ও শক্তিগুলোকে একত্রিত করছে। ইরান ও হিজবুল্লাহর মিলনে এটি শুরু হয়েছিল। তবে এখন আরও শক্তি এতে যোগ দিয়েছে। অন্য সদস্যদের মধ্যে রয়েছে ইয়েমেনের হুতি, হামাস ও ফিলিস্তিনের ইসলামিক জিহাদ এবং ইরাক ও সিরিয়ার শিয়া মিলিশিয়া। পশ্চিমারা কয়েক দশক ধরে মধ্যপ্রাচ্যে যে আঞ্চলিক ব্যবস্থা তৈরি করেছে এবং রক্ষা করেছে, এই অক্ষশক্তি তার জন্য সরাসরি চ্যালেঞ্জ। ইরানি ও হুতিরা লোহিত সাগরে মালবাহী জাহাজে হামলা করছে। এর মানে, এই শক্তি বৈশ্বিক বাণিজ্য ও জ্বালানি সরবরাহের জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
৭ অক্টোবর ইসরায়েলের ওপর হামাসের হামলা এই অক্ষশক্তির ক্ষমতা ও প্রভাবের ইঙ্গিত বহন করছে। এ হামলার পর সংঘাত ফিলিস্তিনি অঞ্চল ছাড়িয়ে ইরান, ইরাক, লেবানন, সিরিয়া ও ইয়েমেন পর্যন্ত বিস্তৃত। পশ্চিমারা তেহরানকে এই নেটওয়ার্কের ‘নাটের গুরু’ হিসেবে দেখে এবং এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, প্রতিরোধ অক্ষের এই শক্তিগুলোর কর্মতৎপরতা ইরানের কৌশলগত পরিকল্পনারই অংশ। বস্তুত, ইরানের বিপ্লবী গার্ড অক্ষশক্তির সদস্যদের প্রাণঘাতী সামরিক অস্ত্র দেওয়া ছাড়াও সমন্বয়ের কাজ করছে।
তবে এ অক্ষের সদস্যরা ইরানের পুতুল নয়; তারা বরং মার্কিন ও ইসরায়েলি ‘ঔপনিবেশিকতা’কে ঘৃণা করে। হিজবুল্লাহ বিশ্বাস করে, ওয়াশিংটন ও তেল আবিব লেবাননে হস্তক্ষেপ করছে। হামাস, হুতি ও ইরাকের শিয়া মিলিশিয়ারাও এমনটি বিশ্বাস করে। নাসরাল্লাহ যেমন বলেছেন, ভিন্ন ভিন্ন দল একই বাস্তবতায় একত্র হয়েছে; লেবানিজ, ফিলিস্তিনি বা ইয়েমেনি– সবার একই সমস্যা এবং সবারই শত্রু অভিন্ন। এর মানে হলো, এ অঞ্চলে যা ঘটছে, তা অন্যদের জন্য সমান প্রাসঙ্গিক। কেবল ইরানের স্বার্থের পরিবর্তে অক্ষের মিত্ররা ‘সকলের তরে সকলে আমরা’ এই চেতনায় ঐক্যবদ্ধ। অক্ষের মিত্ররা বিশ্বাস করে, তারা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে একই যুদ্ধে অবতীর্ণ এবং পরোক্ষভাবে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করছে। এর মানে, মার্কিন সতর্কবাণী বা আক্রমণ কোনোটিই অক্ষকে থামাতে পারবে না। যতক্ষণ গাজায় ইসরায়েলি হামলা চলছে; এর নাগরিকরা মুক্ত না হচ্ছে এবং ফিলিস্তিনি সার্বভৌমত্ব ও আত্মনিয়ন্ত্রণের বিশ্বাসযোগ্য পথ তৈরি না হচ্ছে, ততক্ষণ তারা নিবৃত্ত হবে না এবং যুক্তরাষ্ট্রও বিপজ্জনক খেলা থেকে বের হতে পারবে না।
ফিলিস্তিন ইস্যুটি সামনে আসায় ইরান ও হিজবুল্লাহ উভয়েরই সুবিধা হয়েছে। এটি ইসরায়েলকে বেকায়দায় ফেলছে, একই সঙ্গে ইসরায়েল ও আরব দেশগুলোর মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনাও কমেছে। তারা একটি বহুমুখী যুদ্ধে ইসরায়েলকে ব্যস্ত রাখছে। এ সংঘাত ইরানের দীর্ঘদিনের উদ্দেশ্য হাসিলে সহায়ক। ইসরায়েল হয় নিজস্ব বিষয়ে ব্যস্ত থাকবে, না হয় ইরানের সঙ্গে সংঘাতে ব্যস্ত থাকবে।
হামাসের আক্রমণের প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েলি আক্রমণের মাত্রা এবং হিংস্রতায় যে মানবিক বিপর্যয় ঘটেছে এবং তাতে বিশ্বের যে মনোযোগ আকর্ষিত হয়েছে, তা অপ্রত্যাশিত। ৭ অক্টোবরের আক্রমণটি এতটা সফল হবে, তা হামাস ও তার মিত্ররা ধারণাও করেনি। তারা ভেবেছিল, ইসরায়েলে তাদের অভিযানে হতাহত হবে সীমিত সংখ্যক এবং ইসরায়েলি কিছু জিম্মি আটক হবে। আর ইসরায়েল গাজা আক্রমণ করলেও খুব বেশি নৃশংসতা চালাবে না। হামাসের আক্রমণের সাফল্য এবং ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়ার মাত্রা তাই হামাসের মিত্রদেরও হতবাক করে দিয়েছে। ফলে তারা লক্ষ্য ও কৌশল পুনর্নির্ধারণ করছে।
যদিও ইরান বা হিজবুল্লাহ কেউই বৃহত্তর আঞ্চলিক যুদ্ধ চায় না, তবুও তারা ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ইসরায়েল ও মার্কিন বাহিনী উভয়কেই নিশানা করেছে। হুতিরা লোহিত সাগরে জাহাজ চলাচল ব্যাহত করে লড়াইয়ে যোগ দিয়েছে। তারা এটি করেছে শুধু ফিলিস্তিনিদের প্রতি সমর্থন দেখানোর জন্যই নয়; যুদ্ধ সম্প্রসারণে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলকে বাধা দেওয়ার জন্যও। তারা দেখিয়ে দিয়েছে, অক্ষ সদস্যদের যুদ্ধের ইচ্ছা রয়েছে। তারা আশা করে, এই সংকল্প ইসরায়েলকে সংঘাত সম্প্রসারণ থেকে বিরত রাখবে। একই সঙ্গে তেল আবিবকে নিজের ফ্রন্টে সংঘাত চালানোর চেয়ে সব ফ্রন্টে সংঘাতে প্রলুব্ধ করবে।
অক্ষশক্তির মিত্রদের এ প্রতিরোধ দীর্ঘ পরিকল্পনার অংশ। গাজা যুদ্ধ নেটওয়ার্ককে পশ্চিমাদের ওপর সামরিক ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর আক্রমণ চালানোর সবচেয়ে বড় সুযোগ এনে দিয়েছে। এরই মধ্যে এটি তার অস্ত্র এবং সৈন্যশক্তির মাধ্যমে এ অঞ্চলে নিজেকে জাহির করতে পেরেছে; বিশ্বব্যাপীও তার বার্তা পৌঁছে দিয়েছে।
ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যকে বদলে দিয়েছে; মানুষের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ জাগিয়েছে। পশ্চিমের প্রতি এ শত্রুতা নতুন চরমপন্থা এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার জন্ম দিতে পারে। এ অঞ্চলের শাসকদের জন্য এমনকি যাদের ওয়াশিংটন মিত্র হিসেবে গণ্য করে, এই যুদ্ধ তাদের নিজস্ব নিরাপত্তা এবং পশ্চিমের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের মৌলিক ধারণা বদলে দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র এই অক্ষশক্তিকে সহজে ভাঙতে পারবে না বা একে কেন্দ্র করে যেসব ধারণা জন্ম নিয়েছে, সেগুলোও পরাজিত করতে পারবে না। এর একমাত্র সহজ সমাধান হলো গাজা যুদ্ধের অবসান এবং ইসরায়েল-ফিলিস্তিন বিষয়ে বাস্তব ও ন্যায্য সমাধানের জন্য আলোচনা করা। এটি করা না হলে এই অক্ষশক্তির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রকে আগামী বহু বছর লড়াই করতে হবে।
নারগিস বাজগলি ও ভ্যালি নাসর: লেখকদ্বয় যথাক্রমে জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটির মিডল ইস্ট স্টাডিজের সহকারী অধ্যাপক ও অধ্যাপক; ফরেন অ্যাফেয়ার্স থেকে সংক্ষেপিত, ভাষান্তর
মাহফুজুর রহমান মানিক