২০২৪ সালে বিশ্বজুড়ে হতে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনগুলোর আরেকটি হয়ে গেল তাইওয়ানে। চীনের কাছের দ্বীপটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হলেন চীনবিরোধী হিসেবে পরিচিত লাই চিং তে। তিনি তাইওয়ানের ক্ষমতাসীন এবং স্বাধীনতাপন্থী ডেমোক্রেটিক প্রোগ্রেসিভ পার্টির (ডিপিপি) প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এবারের নির্বাচনে জয়ের মাধ্যমে দলটি টানা তৃতীয়বারের মতো তাইওয়ানের ক্ষমতায় আসল।
সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, গণনার সর্বশেষ ফল অনুযায়ী ১ কোটি ৯০ লাখ ভোটারের এই নির্বাচনে লাই চিং তের পক্ষে গেছে ৪০ শতাংশ ভোট। অন্যদিকে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী কুনমিনতাং দলের প্রার্থী হো ইয়ু-ইহ পেয়েছেন ৩৩ শতাংশ ভোট। ২৬ শতাংশ ভোট পেয়ে তৃতীয় অবস্থানে আছেন তাইওয়ান’স পিপলস পার্টির কো ওয়েন-জে। ইতিমধ্যে নিজেদের পরাজয় মেনে নিয়ে লাইকে অভিনন্দন জানিয়েছেন তারা।
জয় নিশ্চিতের পর রাজধানী তাইপেতে অবস্থিত দলীয় কার্যালয়ের সামনে জড়ো হওয়া সমর্থকদের উদ্দেশে বক্তব্য দেন লাই। তিনি বলেন, ‘দেশের গণতন্ত্রে নতুন অধ্যায় লেখার জন্য তাইওয়ানিজ জনগণকে আমি ধন্যবাদ দিতে চাই। আমরা বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছি গণতন্ত্রকে আমরা কতটা চাই। এটা আমাদের অবিচল প্রত্যয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘গণতান্ত্রিক ধারায় বিশ্বাসীদের জন্য তাইওয়ানের এই জয়।’
লাই চিং তে, উইলিয়াম লাই নামেও পরিচিত। ২০২০ সালে তাইওয়ানের ভাইস প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে তিনি একজন আইনপ্রণেতা ছিলেন। এ ছাড়া ২০১৭ ও ২০১৯ সালে বিদায়ী প্রেসিডেন্ট সাই ইং ওয়েনের প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। এর আগে দুই মেয়াদে দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর তাইনানের জনপ্রিয় মেয়র ছিলেন তিনি
প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে তিনি পূর্বসূরি সাইয়ের পথই কঠোরভাবে অনুসরণ করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সাইয়ের নীতি হলো চীন থেকে বিচ্ছিন্ন ভূখণ্ড হিসেবে তাইওয়ানকে স্বাধীন একটি দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। তাই নতুন প্রেসিডেন্ট লাইয়ের নীতি কী হবে, তা আর বলার দরকার নেই। অথচ চীন ২ কোটি ৪০ লাখ জনগোষ্ঠীর তাইওয়ানকে নিজেদের ভূখণ্ড হিসেবে বিবেচনা করে। প্রয়োজনে তাইওয়ানকে জোরপূর্বক একীভূত করার হুমকিও দিয়ে রেখেছে বেইজিং।
লাই অবশ্য রাজনীতিতে আসার অনুপ্রেরণা পেয়েছেন চীনের কাছ থেকেই। তিনি তাইওয়ানের উত্তরাঞ্চলের একটি দরিদ্র গ্রাম থেকে উঠে এসেছেন। সেই গ্রামে ছিল কয়লাখনি। তার বাবা ছিলেন কয়লাশ্রমিক। তিনি যখন ছোট, তখনই তার বাবা মারা যান। এরপর তার মা একাই ছয় সন্তানকে বড় করেন।
লাইয়ের মুখপাত্রের ভাষ্য, শৈশবে দেখা লাইয়ের দুঃখকষ্টই তাকে সুবিধাবঞ্চিত ও সংখ্যালঘুদের প্রতি সমব্যথী হতে শিখিয়েছেন। তিনি তাইওয়ানের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ে মেডিসিন বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন। পরে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জনস্বাস্থ্যের ওপর স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন।
চার দশকের সামরিক শাসন থেকে বেরিয়ে আসার এক দশক পর ১৯৯৬ সালে তাইওয়ানে প্রত্যক্ষ ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তখন থেকেই ডিপিপির প্রার্থীর পক্ষে কাজ করে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন লাই।
লাই ২০১৭ সালে নিজেকে ‘তাইওয়ানের স্বাধীনতার জন্য বাস্তববাদী কর্মী’ হিসেবে অভিহিত করে চীনের ক্ষোভ উসকে দিয়েছিলেন। বেইজিংয়ের কর্মকর্তারা সম্প্রতি তাকে ‘তাইওয়ানের স্বাধীনতার নিয়ে মিথ্যাচারকারী’ এবং ‘চূড়ান্ত পর্যায়ের দুর্বৃত্ত’ বলে অভিহিত করেন।
এখন লাই প্রেসিডেন্ট হওয়ায় তাইওয়ান প্রণালীতে চীনের আরও তৎপরতা বাড়বে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
নির্বাচনে আগে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ইকনমিস্টেরর প্রতিবেদন অনুযায়ী, উত্তেজনা ছড়ানোর আশঙ্কায় আছেন মার্কিন কর্মকর্তারাও। লাইয়ের লাগামহীন কথাবার্তার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের এ আশঙ্কা অমূলক নয়। গত বছর লাই বলেছিলেন, তিনি আশা করেন তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট এমন কিছু করবেন, যাতে নজির ভেঙে যাবে এবং চীনও ফুঁসে উঠবে, আর তা হলো তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট একদিন ‘হোয়াইট হাউসে ঢুকতে পারবেন’।
যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানের প্রধান সমর্থক হলেও সে তুলনায় চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক অনেক বেশি। ওয়াশিংটন তাইওয়ানকে আড়াল থেকে সহায়তা করলেও বেইজিংকে বরাবরই বলে আসছে তারা এক চীন নীতির বিরুদ্ধে যাবে না।
লাই জিতেছেন, স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেওয়া যায় তার দেশ এখন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর আরও নির্ভরশীল হবে। হবে। লাই চাইবেন তাইওয়ানের ভঙ্গুর সার্বভৌমত্ব শক্তিশালী হোক। এ কাজে একমাত্র যুক্তরাষ্ট্র তাদের সহায়তা করতে পারে। তিনি চীনের ওপর থেকে অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতাও কমিয়ে আনতে চান।
গত বছরের প্রথম ১১ মাসের চিত্র দেখলে বোঝা যায়, তাইওয়ানের রপ্তানি আয়ের ৩৫ শতাংশ এসেছে চীনের মূল ভূখণ্ড ও হংকং থেকে। নির্বাচনী প্রচারণায় লাই আশা করেছিলেন, তিনি ক্ষমতায় এলে তাইওয়ান অন্যান্য দেশের সঙ্গে আরও বাণিজ্য চুক্তি করতে পারবে এবং বিশ্বজুড়ে ‘গণতান্ত্রিক দেশগুলোর সঙ্গে অংশীদারত্ব আরও জোরদার করতে পারবেন। একই সঙ্গে তিনি এও বলেন, প্রণালির ওই পারের শক্তির সঙ্গে আলোচনায় বসতে তিনি এখনো প্রস্তুত।