হাত খুলে টাকা খরচ করার জো নেই। হরেক সংকটে চিড়েচ্যাপ্টা মানুষ এখন সংযমী। তাই বিকিকিনি শিকেয় উঠেছে ফুটপাতের দোকানে দোকানে। কেনাবেচা ঠনঠন হলেও ‘মাফ’ নেই চাঁদা। দিনের চাঁদা, সপ্তাহের চাঁদা ঠিকঠাক তুলে দিতে হচ্ছে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা কিংবা প্রভাবশালীর হাতে। এর সঙ্গে ‘গোদের ওপর বিষফোড়া’ বিরোধী দলগুলোর দফায় দফায় হরতাল-অবরোধ। দিনের পর দিন নিত্যপণ্য চড়তে থাকায় চড়া মাশুল গুনছেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা।
তেমনই একজন মোহাম্মদ আলাউদ্দিন। গুলিস্তানে ফুলবাড়িয়া বাস টার্মিনাল এলাকায় সড়কে ভ্যানে প্লাস্টিকের স্যান্ডেল বেচেন, তাও আট বছর হবে। সরকারি জায়গায় ভ্যানে স্যান্ডেল বিক্রি করলেও ভাড়া হিসেবে গুনতে হয় চাঁদা। তাঁর ভাষ্য, এখন নানা কারণে ব্যবসা মন্দা। বেচাকেনা নেমেছে অর্ধেকে।
তবে চাঁদার টাকা কমেনি, বেড়েছে উল্টো। ছয় মাস আগেও দৈনিক চাঁদা দিতে হতো ১৫০ টাকা। এখন প্রতিদিন ১৫০ টাকা ছাড়াও সপ্তাহে ১ হাজার ৫০০ টাকা দিতে হয়। সে হিসাবে মাসে ছয় হাজার টাকা অতিরিক্ত গুনতে হচ্ছে তাঁকে। এই টাকা স্থানীয় থানা পুলিশসহ নির্দিষ্ট ব্যক্তিরা নেন বলে অভিযোগ আলাউদ্দিনের।
রাজধানীর গুলিস্তান, পল্টন, মতিঝিল, মালিবাগ, রামপুরা, ফার্মগেট, শাহবাগ, মিরপুর, বাড্ডাসহ বিভিন্ন এলাকার ফুটপাত ঘুরে দেখা গেছে, প্রায় সব এলাকার ফুটপাত চলে গেছে অবৈধ দখলে। সরকারি জায়গা ভাড়া দিয়ে খাচ্ছে এলাকাভিত্তিক চাঁদাবাজরা। এলাকাভিত্তিক স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তির এসব ফুটপাত নিয়ন্ত্রণে সরাসরি ভূমিকা রয়েছে। ফুটপাতের চাঁদার টাকা যাচ্ছে সংশ্লিষ্ট এলাকার পুলিশের পকেটেও।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে থানা বা ফাঁড়ির টহল পুলিশ সরাসরি দোকানির কাছ থেকে টাকা ওঠায়। চাঁদার টাকা দিয়েই ব্যবসা করতে চান ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। তবে বেচাকেনা কমে যাওয়ায় চাঁদার টাকা দেওয়া কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ছে তাদের। এমনও দিন আছে, কোনো কোনো ব্যবসায়ীকে খালি পকেটে ঘরে ফিরতে হচ্ছে। ব্যবসা টিকিয়ে রাখাও কষ্টকর হয়ে পড়ছে অনেকের। ব্যবসা মন্দা যাওয়ার কারণ হিসেবে তারা বলছেন, সাধারণত স্বল্প আয়ের মানুষ ফুটপাত থেকে পোশাকসহ নিত্যদিনের জিনিসপত্র কেনাকাটা করে। নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার কারণে তারা আগের মতো কেনাকাটা করছে না।
মিরপুর ১৩ নম্বরের বিদ্যুতের গলিতে রাস্তার পাশে চা, বিস্কুট, সিগারেট বেচেন এক যুবক। ভ্যানের ওপর ভাসমান দোকান তাঁর। নিজের নাম প্রকাশ না করে তিনি জানান, ৯ বছর ধরে তিনি একই স্থানে এসব বিক্রি করছেন। শুরুতে চাঁদা ছিল দিনে ৩০ টাকা। ৯ বছরের ব্যবধানে সেই চাঁদার পরিমাণ এখন ৩০০ টাকা। বছরখানেক আগে ছিল ২০০ টাকা। তপন নামে এক ব্যক্তি এই এলাকার ফুটপাত নিয়ন্ত্রণ করেন। তাঁর লাইনম্যান হিসেবে কাজ করেন বাদশা নামে এক ব্যক্তি।
বেচাকেনা কেমন হচ্ছে– জানতে চাইলে ওই যুবক বলেন, ‘দোকানে আগের মতো ভিড় নেই। আগে দিনে ৮ হাজার থেকে ৯ হাজার টাকা বিক্রি করতাম। এখন হয় ৫ হাজার থেকে ৬ হাজার টাকা। কিন্তু চাঁদার টাকা কমেনি।’
মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্বরের অদূরে সেনপাড়ার পাঁচ নম্বর সড়কে ভ্যানের ওপর থরে থরে সবজি সাজিয়েছেন মো. শাজাহান। তিনি বলেন, ‘জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়ায় বেচাকেনা কমেছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, যে ব্যক্তি আগে এক কেজি বেগুন কিনতেন এখন কেনেন হাফ কেজি বা তার চেয়েও কম।’
মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনের দুই পাশের সড়ক ও ফুটপাত নিয়ন্ত্রণ করেন সাইফুল মোল্লা নামে এক ব্যক্তি। ফুটপাতে চাঁদাবাজির অভিযোগে কারাভোগও করেছেন তিনি। তবে চাঁদাবাজি ছাড়েননি। ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ‘হাত’ হিসেবে টাকা আদায় করেন তিনি। ‘চার হাত বাই চার হাত’ জায়গার ভাড়া হিসেবে প্রতিদিনের চাঁদা ২০০ টাকা।
তবে শুক্রবার হলিডে মার্কেটের দিন একই জায়গার ভাড়া হয়ে যায় দ্বিগুণ– ৪০০ টাকা। ফুটপাতে এক বোরকা ব্যবসায়ী বলেন, ‘সাইফুল মোল্লার ছেলে শিপুল চাঁদার টাকা তোলে। এ ছাড়া তার লোকজনও বিভিন্ন সময় চাঁদা ওঠায়।’ সাইফুল মোল্লা সড়ক ও ফুটপাত সিটি করপোরেশন থেকে ইজারা নিয়েছেন বলে ব্যবসায়ীদের কাছে জানিয়েছেন। আদৌ ফুটপাত বা সড়ক ইজারা নেননি তিনি।
ওই সড়কের ডাব ব্যবসায়ী মনোয়ার হোসেন বলেন, ‘শুনেছি সাইফুল মোল্লা এই জায়গা ইজারা নিয়েছেন। প্রতিদিন ২০০ টাকা চাঁদা দিই তাঁকে। শীতে ডাব বিক্রি অর্ধেকে নেমে এসেছে। এর পরও চাঁদার পরিমাণ কমেনি।’ ব্যবসায়ীরা জানান, চাঁদার টাকা সাইফুল মোল্লা একাই ভোগ করেন না, সরকারদলীয় স্থানীয় কিছু নেতাকর্মী ও স্থানীয় থানা পুলিশকে ভাগ দিতে হয়।
মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে রাস্তা দখল করে বিভিন্ন পণ্যের দোকান দীর্ঘদিনের। শীতের পোশাক ও গেঞ্জি বিক্রেতা হরিপদ জানালেন, কয়েক স্তরে চাঁদার টাকা দিতে হয় ব্যবসায়ীদের। লাইনম্যানরা এসব টাকা তোলে। আক্ষেপের সুরে তিনি বলেন, ‘আজ সারাদিনে ৬০ টাকা বিক্রি করেছি। কিন্তু চাঁদা দিতে হয়েছে ১৮০ টাকা। চাঁদা মাফ নেই। বিক্রি হোক না হোক দোকান নিয়ে বসলে চাঁদার টাকা দিতেই হবে।’ বিক্রি কম কেন– জিজ্ঞেস করলে বলেন, ‘মানুষ গ্রামে চলে যাচ্ছে। অন্য সময় শাপলা চত্বর এলাকায় সবসময় মানুষের ভিড় লেগে থাকত। এখন লোকজন কম।’
একই এলাকায় শিশুদের প্লাস্টিকের খেলনা বিক্রেতা মজিবুর রহমান জানান, দুই স্তরে পুলিশ টাকা নেয় তাঁর কাছ থেকে। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত টহলে যাওয়া একটি পুলিশের গাড়ি এবং দুপুরের পর টহলে যাওয়া আরেকটি পুলিশের গাড়ি। তবে পুলিশ নিজ হাতে তোলে না। অন্য লোকজন দিয়ে ওঠায়। দুইবারে ৬০ টাকা করে নেয় তাঁর কাছ থেকে। এ ছাড়া আরেকজন লাইনম্যান ১০০ টাকা নেয়।
গুলিস্তানের বিভিন্ন সড়কে জুতা-স্যান্ডেল, বেল্ট, গেঞ্জি, প্যান্ট, ফলমূলসহ বিভিন্ন পণ্যের দোকান রয়েছে। এখন চাঁদার পরিমাণ দ্বিগুণ হয়েছে। আগে যে দোকানিকে ৩০০ টাকা দিতে হতো এখন দিতে হচ্ছে ৬০০ টাকা। এ টাকার ভাগ পুলিশ থেকে শুরু করে স্থানীয় রাজনৈতিক কিছু নেতার পকেট পর্যন্ত যায়। আহাদ পুলিশ বক্স ফাঁড়ির এক কর্মকর্তাও টাকার ভাগ পেয়ে থাকেন।
এ এলাকায় ফুটপাত ও সড়ক দখল করে বসানো দোকানগুলো ৩০টি লাইনে বিভক্ত। একেক অংশে আলাদা নিয়ন্ত্রক ও লাইনম্যান রয়েছে। এসব এলাকায় চাঁদাবাজি করেন ক্যাশিয়ার দুলাল, সরদার বাবুল, নাসির, লম্বা হারুন, আলী, কালা নবী, আক্তার, মিজান, চাটগাঁও হারুন, লিপু, সুলতান, কাদের, রজব, বিমল, হান্নান, লম্বা বাবুল, শাজাহান, মাসুম, সালামসহ অন্তত অর্ধশতজন।
বাড্ডার সুবাস্তু টাওয়ারের অদূরে ফুটপাতে শার্ট, প্যান্ট, গেঞ্জি বিক্রি করেন এক তরুণ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি জানান, বছরখানেক আগেও দিনে ২০০ টাকা চাঁদা দিতেন। এখন দিতে হয় ৩০০ টাকা। টাকা না দিলে বসতে দেওয়া হয় না।
ফার্মগেটের পূর্ব পাশে ফ্লাইওভারের সিঁড়ির সঙ্গে বসা এক বাদাম বিক্রেতা জানান, দীর্ঘদিন ধরে তিনি সেখানে বাদাম বিক্রি করছেন। জায়গার ভাড়া হিসেবে কামাল নামে এক লাইনম্যানকে প্রতিদিন ১০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়।
ফার্মগেট পশ্চিম পাশের এক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, শীতের সময় তিনি শীতের পোশাক বিক্রি করেন। তবে এবার ঢাকায় তেমন শীত না থাকায় বেচাকেনা কম। চাঁদার টাকা কম দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই বলেও জানালেন। ফার্মগেট সেজান পয়েন্টের সামনের ফুটপাতে জিন্সের প্যান্ট ব্যবসায়ী মো. জিয়া বলেন, আমার বেচকেনা তিন ভাগের এক ভাগে নেমে এসেছে। তবে চাঁদাবাজি কমেনি।
বাংলাদেশ হকার্স লীগের সভাপতি এম এ কাশেম সমকালকে বলেন, লাইনম্যান নামধারী চাঁদাবাজদের গ্রেপ্তার করতে হবে। একই সঙ্গে হকারদের পুনর্বাসন করে তাদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায় করতে হবে সরকারকে। এতে সরকার যেমন অর্থিক লাভবান হবে, তেমনি হকাররা চাঁদাবাজি থেকে মুক্তি পাবে। এতে বৈধভাবে ব্যবসা করতে পারবেন ব্যবসায়ীরা।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) উপপুলিশ কমিশনার (মিডিয়া) ফারুক হোসেন সমকালকে বলেন, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতার ছত্রছায়ায় ফুটপাতে জায়গা দখল করে অবৈধভাবে তারা ব্যবসা করেন। ফলে পুলিশ সকালে উঠিয়ে দিলে বিকেলে আবার বসেন।
ফুটপাতকেন্দ্রিক রাজনীতির সঙ্গে যারা জড়িত এবং পুলিশের মাঠ পর্যায়ে যারা কাজ করে তারাও অনেক সময় তাদের সহযোগিতা করে। তাই পুলিশ ও স্থানীয় রাজনীতি সমন্বয় না করতে পারলে ফুটপাত দখলমুক্ত করা কঠিন। তিনি বলেন, ফুটপাত দখলমুক্ত করতে সম্প্রতি সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলরদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। পর্যায়ক্রমে ঢাকার ফুটপাত দখলমুক্ত করা হবে।