ক্যামেরা দেখেও তাদের মধ্যে কোনো বিকার নেই। শিশুরা খুব একটা তাকাচ্ছেও না। এই শিশুরা তাদের চারপাশে প্রতিনিয়ত দেখছে মৃত্যু, মৃতপ্রায় এবং মৃত্যুর অপেক্ষায় থাকা মানুষদের। আর কীইবা তাদের অবাক করবে? ক্ষুধা তাদের কাবু করে ফেলেছে।
একেবারেই কিছুই হয়তো পাবে না জেনেও তারা লাইনে অপেক্ষা করে সামান্য রেশনের জন্য।
আমার যে সহকর্মী বিবিসির জন্য ছবি তুলছেন, এই শিশুরা তাকে এবং তার ক্যামেরা নিয়মিত দেখে অভ্যস্ত।
শিশুদের ক্ষুধা, তাদের মৃত্যু, মৃত্যুর পর আলতোভাবে তাদের শরীর, কখনোবা শরীরের কিছু অংশ সাদা কাফনে জড়িয়ে দেয়া- এই সবই দেখে চলেছেন আমার সহকর্মী। তার নিরাপত্তার জন্য আমি তার নাম প্রকাশ করছি না
যদি মৃত শিশুর নাম জানা থাকে তাহলে কাফনের ওপর তাদের নাম লিখে দেয়া হয়, অনেকেই থেকে যায় অজ্ঞাত।
উনিশ মাসের এই যুদ্ধে স্থানীয় এই ক্যামেরাম্যান হাসপাতালের আঙ্গিনায় অসংখ্য বেঁচে আসা মানুষের কান্না শুনেছেন।
শারীরিকভাবে দূরে থাকলেও তার মনে সবসময়ই তারা থাকেন। কারণ তিনিও তাদের মতই দমবদ্ধ করা এক নরকে আটকা পড়েছেন।
আজ সকালেই তিনি চেষ্টা করেছে সিওয়ার আশৌর নামের পাঁচ মাস বয়সী একটি মেয়েকে খুঁজতে। তিনি আমাকে লিখেছিলেন, খান ইউনিসের নাসের হাসপাতালে মেয়েটির কান্না তার হৃদয় ভেঙ্গে দিয়েছিলো। চলতি মাসের শুরুতে ফুটেজ নেয়ার জন্য তিনি সেখানে গিয়েছিলেন।
মেয়ে শিশুটির ওজন ছিলো মাত্র দুই কেজির একটু বেশি। অথচ পাঁচ মাসের একটি বাচ্চার ওজন হওয়া উচিত ৬ কেজি কিংবা তারও বেশি।
তিনি শুনেছেন মেয়েটিকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে এবং সে বাড়িতে আছে। সেটিই তাকে তাদের অস্থায়ী আশ্রয় শিবিরে নিয়ে এসেছে।
একটি কঠিন পরিস্থিতিতে মেয়েটির সন্ধান করছিলেন তিনি। কয়েক দিন আগে তিনি আমাকে জানিয়েছিলেন যে তিনি ভালো নেই, ইসরাইলি আর্মি খান ইউনিসের বেশিরভাগ এলাকা খালি করার ঘোষণা দিয়েছে।
আল মাওয়াইসিতে বাস্তুচ্যুত মানুষদের প্রচণ্ড ভিড়। কোন দিকে যেতে হবে সেটা বোঝাই মুশকিল। সেখানেই একটি খুপরি ঘর খুঁজে পায় সে। সিওয়ার সেখানে ছিলো তার মা নাজওয়া ও নানী রিমের সাথে।
সিওয়ার ছিলো শান্ত। অ্যালার্জির জন্য সাধারণ গুড়ো দুধ সে হজম করতে পারে না । যুদ্ধ এবং ইসরাইলের অবরোধের কারণে সেখানে তার প্রয়োজনীয় শিশুদের ফর্মুলারও তীব্র সংকট।
তেইশ বছর বয়সী নাজওয়া বলছিলেন যে নাসের হাসপাতালে থাকার সময় তার অবস্থা কিছুটা স্থিতিশীল হয়। পরে চিকিৎসকরা এক ক্যান গুড়ো দুধ দিয়ে তাকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেয় কয়েকদিন আগে।
এখন বাড়িতে এসেছে কিন্তু তার ওজন আবার কমতে শুরু করেছে।
“ডাক্তার বলেছে সিওয়ার আগের চেয়ে ভালো কিন্তু আমার মনে হয় তার যথেষ্ট উন্নতি হয়নি। তারা এক ক্যান দুধ দিয়েছে। কিন্তু সেটিও শেষ হওয়ার পথে”।
সিওয়ার মুখের সামনে মাছি উড়ছিল। “পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ,” বলছিলেন নাজওয়া।
“ওর দিকে কীটপতঙ্গ উড়ে আসে। আমি স্কার্ফ দিয়ে ওর মুখ ঢেকে রাখি যেন কিছু স্পর্শ করতে না পারে”।
নভেম্বরে জন্মের পর থেকেই যুদ্ধের শব্দের মধ্যেই বাস করছে সিওয়ার। গোলাবারুদ, রকেট, বোমা পড়ছে কাছে এবং দূরে।
গুলি কিংবা ইসরাইলের ড্রোন ঘুরছে মাথার ওপর।
নাজওয়া বলেন: “এগুলো সে বুঝতে পারে। ট্যাংক, যুদ্ধবিমান কিংবা রকেটের বিকট শব্দ-এগুলো আমাদের খুব কাছে। সিওয়ার যখন এসবের শব্দ শোনে সে কান্না করতে শুরু করে। ঘুম থেকে উঠে চমকে যায় ও কান্না করতে শুরু করে”।
চিকিৎসকরা বলছেন, অপুষ্টির কারণে কম বয়েসি অনেক মায়েরা তাদের শিশুকে বুকের দুধ পান করাতে পারছে না। এখন বড় সংকট হলো খাবার ও বিশুদ্ধ পানির।
সিওয়ারের জন্মের সময়েই নাজওয়া অপুষ্টিতে ভুগছিলেন। তিনি ও তার মায়ের জন্য খাবার সংগ্রহ করাই কঠিন হয়ে পড়ছিলো। তার মা বলছিলেন যে “আমাদের ক্ষেত্রে সীমান্ত বন্ধ থাকা ও দাম বেড়ে যাওয়ায় দুধ ও ডায়াপার কেনা যাচ্ছিলো না”।
ইসরাইলি মিলিটারি সংস্থা কোগাট বলেছেন গত ২২ মে বলেছে গাজায় কোনো খাদ্য সংকট নেই। তারা বলেছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ শিশু খাদ্য ও ময়দা সাম্প্রতিক সময়ে সেখানে পৌঁছেছে।
সংস্থাটি বারবার অভিযোগ করছে যে হামাস ত্রাণ চুরি করছে। অন্যদিকে ইসরাইল সরকার বলছে হামাস ধ্বংস ও সব জিম্মি মুক্তি না পাওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ অব্যাহত থাকবে।
প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর দাবি অন্তত কুড়ি জন জিম্মি এখনো জীবিত অবস্থায় হামাসের হাতে আছে। আর মারা গেছে ৩০ জনের বেশি।
জাতিসংঘ ও ব্রিটেনসহ অনেক দেশের সরকার কোগাটের মন্তব্য প্রত্যাখ্যান করেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পও গাজার ক্ষুধার্ত মানুষের কথা উল্লেখ করেছেন।
জাতিসংঘ মহাসচিব বলেছেন ইসরাইল যে পরিমাণ সহায়তা নিতে দিচ্ছে তা প্রয়োজনের তুলনায় এক ‘চা চামচের’ মতো।
তিনি বলেছেন তেল, আশ্রয়, রান্নার গ্যাস ও বিশুদ্ধ পানির অভাবে ফিলিস্তিনিরা এখন নিষ্ঠুর একটি সংঘাতের নিষ্ঠুরতার চূড়ান্ত ধাপে আছে।
জাতিসংঘের মতে গাজার ৮০ শতাংশ জায়গাই হয় এখন ইসরাইলের সামরিক জোন বা এমন জায়গা যেখান থেকে লোকজনকে সরে যেতে বলা হয়েছে।
প্রত্যাখ্যান, উদ্বেগ, নিন্দা এবং নানা টার্নিং পয়েন্ট এসেছে ও গেছে এই যুদ্ধে। কিন্তু সবকিছুর মধ্যে অপরিবর্তিত বাস্তবতা হলো নাজওয়া ও তার কন্যা সিওয়ার এর মতো গাজার একুশ লাখ মানুষের দুঃখ-কষ্ট।
“কেউ ভবিষ্যৎ আর অতীত নিয়ে ভাবে না,” বলছিলেন নাজওয়া। সবার চিন্তা বর্তমান ঘিরে, এবং কীভাবে এখন বেঁচে থাকা যাবে। সূত্র: বিবিসি।