রাজধানীর তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী মামুনুর রশীদ। কয়েকজন বন্ধু মিলে থাকেন মেসে, যেখানে মেস ম্যানেজারের দায়িত্বও সামলাচ্ছেন। গতকাল শুক্রবার সকালে মামুনুর মহাখালী কাঁচাবাজারে যান সয়াবিন তেলের ৫ লিটারের একটি বোতল কিনতে। কিন্তু পুরো বাজার তন্নতন্ন করেও খুঁজে পাননি সয়াবিন তেলের ৫ লিটারের বোতল।
পরে দুটি দোকানের একেকটি থেকে ২ লিটার করে ৪ লিটার সয়াবিন তেল কিনে মেসে ফেরেন। মামুনুর দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কাল (বৃহস্পতিবার) সন্ধ্যায় সয়াবিন কিনতে গিয়ে একবার ফিরে এসেছি। দোকান থেকে বলা হয় বোতলের কোনো তেল নেই। খোলা তেল কিনতে বলল, তাও ১৯০ টাকা লিটার দরে। পরে পরিচিত দোকানদার থাকায় ৪ লিটার সয়াবিন তেল নিতে পেরেছি।’
সয়াবিন তেল কিনতে গিয়ে হয়রান হওয়ার এই চিত্র শুধু মহাখালীর মামুনুরের নয়, গোটা রাজধানী জুড়েই খুচরা বাজারে সয়াবিন তেলের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। ক্রেতাদের চাহিদার তুলনায় বাজারে সয়াবিন তেলের সরবরাহ একেবারেই অপ্রতুল। কয়েক সপ্তাহ আগেও বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেলের সংকট দেখা দিয়েছিল। এরপর সরকার ভোজ্যতেল আমদানিতে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) কমালে সরবরাহ কিছুটা বাড়ে। তবে গত কয়েক দিনে বাজারে বোতলজাত সয়াবিনের সরবরাহ তলানিতে নেমেছে।
একনজরে আজকের দেশ রূপান্তর (৭ ডিসেম্বর)একনজরে আজকের দেশ রূপান্তর (৭ ডিসেম্বর)
কিছু কিছু দোকানে যদিও-বা বোতলজাত সয়াবিন তেল পাওয়া যাচ্ছে, তবে সেগুলোর গায়ে থাকা মূল্য ঘষে তুলে ফেলা বা মূল্য দেখা গেলেও তার চেয়ে অনেক বেশি দামে বিক্রি করছেন বিক্রেতারা।
বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম নিয়ে বিতণ্ডায় জড়াচ্ছেন ক্রেতা-বিক্রেতারা। ক্রেতাদের অভিযোগ, একটি গোষ্ঠী যোগসাজশ করে তেলের দাম বাড়ানোর জন্য সংকট তৈরি করছে। অন্যদিকে বিক্রেতাদের ভাষ্য, ভোজ্যতেল কোম্পানিগুলো থেকেই সরবরাহ কম। খুচরা বিক্রেতা ও তেলের পাইকারি সরবরাহকারীদের দাবি, মূলত ভোজ্যতেল পরিশোধনকারী কোম্পানিগুলো বোতলজাত সয়াবিন তেল বাজারে কম ছাড়ছে।
এদিকে বিশ্ববাজারেও বেড়েছে ভোজ্যতেলের দাম। খাদ্যের দাম গত ১৯ মাসের মধ্য সর্বোচ্চ ছিল নভেম্বরে। গতকাল জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য মূল্যসূচকে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, ২০২৩ সালের এপ্রিলের পর নভেম্বরে খাদ্যের দাম সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ভোজ্যতেলের দাম।
শীত নিয়ে আহাওয়া অফিসের নতুন বার্তাশীত নিয়ে আবহাওয়া অফিসের নতুন বার্তা
রাজধানীর খুচরা বাজারের বিক্রেতারা জানান, গত ১৫ দিন ধরে বোতলজাত সয়াবিন তেলের সরবরাহ একেবারে বন্ধ। কিছু পরিমাণ তেল পাওয়া গেলেও তা নির্দিষ্ট শর্ত পূরণ করলে তবেই পাওয়া যাচ্ছে। গতকাল রাজধানীর ফার্মগেট, তেজগাঁও, নিকুঞ্জ ও মহাখালী এলাকার কয়েকটি মুদি দোকান ঘুরে বেশিরভাগ দোকানেই বোতলজাত সয়াবিন মেলেনি। দুই লিটারের বোতলজাত তেল পাওয়া গেলেও ৫ ও ১ লিটারের তেলের বোতল পাওয়া যাচ্ছে না।
মহাখালীর ফাহমিদা জেনারেল স্টোরের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ জিয়াউল কারিম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘তেলের দাম তো বাড়ছে, এখন সরকার আমদানিকারকদের সঙ্গে বসুক, আমদানি বাড়াক, রেট বাড়ানো লাগলে বাড়াক। দেশের কর্তা হলো সরকার। সরকারকেই এটা সমাধান করতে হবে।’
পরিবেশকদের দাবি, পরিশোধনকারী কোম্পানিগুলো তাদের তেল দিচ্ছে না। এজন্য তারা খুচরা পর্যায়ে দোকানিদের সয়াবিন তেল সরবরাহ করতে পারছেন না। তারা প্রচুর পরিমাণে তেলের অর্ডার করে রাখলেও কোম্পানি তেল দিচ্ছে না।
কবরস্থানে মিলল হাতবোমাকবরস্থানে মিলল হাতবোমা
এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিটি গ্রুপের একজন পরিবেশক বলেন, ‘কোম্পানি তেলই দিচ্ছে না। আমার গোডাউনে এক পিস ডিম ভাজি করার মতোও সয়াবিন তেল নেই।
আমি আজ (গতকাল) সকাল থেকেও অনেক অনুরোধ করছি এক গাড়ি তেল দিতে। আমি কোম্পানির কাছে ৫০ লাখ টাকার ওপরে তেল ডিও করে (চাহিদা জানিয়ে রাখা) রেখেছি, কিন্তু কোম্পানি আমাকে তেল দিতে পারছে না। কোম্পানি বলছে, তেল নেই। আমার এলাকায় যেখানে একদিনে তেল লাগে দুশ কার্টন, সেখানে কোম্পানি গত ৪/৫ দিনে আমাকে কোনো তেলই দেয়নি।’
বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, সরবরাহের এই সংকট কৃত্রিম এবং তেলের ব্যবসায়ীরাই তা সৃষ্টি করেছেন। তেলের দাম বাড়ানোর জন্য এই কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে ভোজ্য তেল পরিশোধন কোম্পানিগুলো।
এ প্রসঙ্গে ক্যাবের কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এই সংকটের কোনো কারণ নেই। ব্যবসায়ীরা দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়ার পর সাপ্লাই (সরবরাহ) বন্ধ করে দেয়। যখন সাপ্লাই বন্ধ হয়ে যাবে তখন তারা সরকারের কাছে প্রস্তাব দেবে দাম বাড়ানোর। এ কাজটা আমরা দীর্ঘদিন ধরে দেখে আসছি, এবারও তাই হবে। সংকট নিরসনের জন্য আমরা সরকারকে সবসময় পরামর্শ দেওয়ার চেষ্টা করি।’
এই বাজার বিশ্লেষক আরও বলেন, ‘এখন যে মজুদগুলো আছে, কোথায় কী অবস্থায় আছে এগুলো তদারকি করে দেখতে হবে। কিন্তু সমস্যা হলো যখন এসব তদারকি করতে যাবে তখন ব্যবসায়ীরা বলবে, আমাদের হয়রানি করতে আসছে। ওরা কোনো নিয়মকানুন মানতে চায় না। এখানে আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। অপরাধীকে অপরাধী হিসেবে বিবেচনা করে জাত-ধর্ম নির্বিশেষে বিচার করতে হবে।’
বোতলজাত সয়াবিন তেলের সাম্প্রতিক সরবরাহ সংকট শুরু হয় সপ্তাহ তিনেক আগে। এরপর সরকার ভোজ্যতেল আমদানিতে শুল্ক-কর কমায়। এতে প্রতি কেজি ভোজ্য তেল আমদানিতে শুল্ক-কর ১০ থেকে ১১ টাকা কমেছে। কিন্তু সরকার শুল্ক-কর কমালেও আমদানি বাড়েনি; বরং বাজারে বোতলজাত তেলের সংকট তৈরি হয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে গত বৃহস্পতিবার ভোজ্যতেল পরিশোধন কোম্পানিগুলোকে নিয়ে সভা করে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি)। সভায় ব্যবসায়ীরা জানান, আসন্ন রমজান উপলক্ষে যে পরিমাণ সয়াবিন তেল আমদানি হওয়ার কথা (ঋণপত্র খোলা), তা স্বাভাবিক পর্যায়ে রয়েছে। তবে বিশ্ববাজারের দামের সঙ্গে সংগতি রেখে দেশের বাজারেও ভোজ্য তেলের দাম সমন্বয় করা প্রয়োজন।
শর্ত দিয়ে বিক্রি হচ্ছে সয়াবিন তেলশর্ত দিয়ে বিক্রি হচ্ছে সয়াবিন তেল
ওই আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ইনস্টিটিউট অব কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএমএবি) ও ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশের (আইসিএবি) প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি কমিটি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ট্যারিফ কমিশন। শুল্ক কমানোর পরও কেন ভোজ্য তেলের দাম কমছে না, সেটি দ্রুততম সময়ে পর্যালোচনা করে সুপারিশসহ প্রতিবেদন দেবে এই কমিটি।
বিশ্ববাজারে বেড়েছে দাম : বিশ্বে খাদ্যের দাম গত ১৯ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ ছিল নভেম্বর মাসে। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য মূল্যসূচকে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, ২০২৩ সালের এপ্রিলের পর নভেম্বরে খাদ্যের দাম সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ভোজ্য তেলের দাম। জাতিসংঘের ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন (এফএও) এই মূল্যসূচক তৈরি করে থাকে। বিশ্বব্যাপী খাদ্য বেচাকেনা পর্যবেক্ষণ করে এই সূচক তৈরি করা হয়।
ভোজ্যতেলের দাম একমাসের ব্যবধানে ৫.৭ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে। আর গত বছরের তুলনায় বেড়েছে প্রায় ৩২ শতাংশ। ভোজ্য তেলের এই মূল্যবৃদ্ধির পেছনে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অত্যধিক বৃষ্টিপাতের কারণে পাম তেলের উৎপাদন প্রত্যাশার চেয়ে কম হওয়াকে দায়ী করা হচ্ছে।
বিশ্বব্যাপী ব্যাপক চাহিদার কারণে সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে, অন্যদিকে সরিষা ও সূর্যমুখী তেলের দামও বেড়েছে।