বাংলাদেশি ব্যবসায়ী মুহাম্মদ আজিজ খান সিঙ্গাপুরের শীর্ষ ৫০ ধনীর তালিকায় স্থান পেয়েছেন। বর্তমানে তিনি সিঙ্গাপুরের ৪১তম ধনী হিসেবে পরিচিত। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাময়িকী ফোর্বসের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তাঁর এই অবস্থান নিশ্চিত হয়েছে। ফোর্বসের ২০২৪ সালের বিলিয়নিয়ারদের তালিকায় তাঁর নাম রয়েছে, এবং তিনি ২ হাজার ৫৪৫ নম্বরে আছেন। তাঁর মোট সম্পদের পরিমাণ ১ দশমিক ১২ বিলিয়ন ডলার।
আজিজ খান, যিনি বর্তমানে ৬৮ বছর বয়সী, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত সিঙ্গাপুরের স্থায়ী বাসিন্দা। তাঁকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ত্যাগ করতে হয়েছে। সামিট গ্রুপ, যা বিদ্যুৎ, বন্দর, ফাইবার অপটিকস, আবাসন ও তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস খাতে কাজ করে, তাঁর ব্যবসায়িক উদ্যোগের অংশ। ২০২৩ সালে সিঙ্গাপুরের ধনীদের তালিকায় তিনি ৪২তম স্থানে ছিলেন, কিন্তু ২০২৪ সালে এক ধাপ এগিয়ে ৪১তম স্থান অর্জন করেছেন।
২০১৬ সালে পানামা পেপারসে তাঁর নাম ওঠার পর সামিট গ্রুপের বিরুদ্ধে অর্থ পাচার ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এ বিষয়ে তদন্ত শুরু করলেও সরকারি প্রভাব ও আইনি জটিলতার কারণে এখনও তদন্ত সম্পন্ন হয়নি। বাংলাদেশে বিদ্যুৎ খাতসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ সিঙ্গাপুরে পাচার করার অভিযোগ উঠেছে সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আজিজ খানের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি, বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি) থেকে এমন তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। বিটিআরসি এক সময় সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে সামিট কমিউনিকেশনস তাদের শেয়ার কোন ফি ছাড়া হস্তান্তর করতে পারবে। তবে পরবর্তীতে এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তিত হয়, এবং অভিযোগ উঠেছে যে সামিট কমিউনিকেশন নতুন শেয়ার ইস্যু করার মাধ্যমে আসলে শেয়ার হস্তান্তর ও বিক্রি করছে।
২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত সামিট কমিউনিকেশন টেলিকম ও ইন্টারনেট সেক্টরে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে। সম্প্রতি, প্রতিষ্ঠানটি আবুধাবি ও মরিশাসভিত্তিক দুই কোম্পানির কাছে ১৭০ কোটি ৫ লাখ টাকা মূল্যের নতুন শেয়ার ইস্যু করার জন্য বিটিআরসির অনুমোদন চেয়েছিল। শেয়ার ইস্যুর পর বিটিআরসি ১২ জুন কোম্পানিটিকে কোনো চার্জ ছাড়াই শেয়ার ট্রান্সফারের অনুমতি দেয়। বিটিআরসি শুরুতে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ ফি প্রদানের নিয়ম চাপাতে চেয়েছিল, কিন্তু পরে সামিট কমিউনিকেশন নতুন শেয়ার ইস্যুর অজুহাতে সেই ফি থেকে অব্যাহতি পায়। বিটিআরসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মতে, কোম্পানি আসলে নতুন শেয়ার ইস্যু করার আড়ালে শেয়ার হস্তান্তর ও বিক্রি করছিল।
এছাড়া, সামিট কমিউনিকেশনের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ ফরিদ খান আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও তৎকালীন বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী ফারুক খানের ছোট ভাই। ফরিদ সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে ও আইসিটি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় এর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এই সম্পর্কের কারণে সামিট বিশেষ সুবিধা পাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সামিট কম্পানির শেয়ার বিক্রয় চুক্তির মধ্যে দেখা গেছে, আবুধাবিভিত্তিক কোম্পানি গ্লোবাল এনার্জির শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে একজন হচ্ছেন আদিবা আজিজ খান, যিনি সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আজিজ খানের মেয়ে। নতুন শেয়ার ইস্যুর মধ্যে ১১৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকার ৯ দশমিক ৪৪ কোটি শেয়ার গ্লোবাল এনার্জিকে এবং ৪৮ কোটি ৫৯ লাখ টাকার আরও ৪ দশমিক ৪ কোটি শেয়ার মরিশাসভিত্তিক সেকোইয়া ইনফ্রা টেককে দেওয়া হয়েছে।
৫ আগস্ট, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর, বিটিআরসি আইন সংস্থাকে একটি নতুন চিঠি পাঠায়, যেখানে বলা হয় যে তাদের আইনি মতামত শুধুমাত্র পরামর্শমূলক এবং বাধ্যতামূলক নয়। এর পর, ১৫ আগস্ট বিটিআরসি সামিট কমিউনিকেশনসকে তাদের শেয়ার হস্তান্তরের ফি না দেওয়ার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কথা জানায়। সামিট কমিউনিকেশনের একটি কর্মকর্তা জানান, বিটিআরসির দেওয়া চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে, কোম্পানিটি ইতিমধ্যেই নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে ১০ কোটি ২৪ লাখ টাকা জমা দিয়েছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান মন্তব্য করেন যে, সামিট কমিউনিকেশনের অর্থ নয়ছয় এবং পরে অর্থ প্রদান, সামিট গ্রুপের ক্ষমতার অপব্যবহারের একটি উদাহরণ। তিনি উল্লেখ করেন যে, এই অর্থ প্রদান অন্যত্র আর্থিক অনিয়ম লুকানোর চেষ্টা হতে পারে এবং সরকারের উচিত সুষ্ঠুভাবে ক্ষমতা প্রয়োগ করে দেশের আর্থিক অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।
ফোর্বসের সর্বশেষ তালিকা অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বের শীর্ষ ধনীর তালিকার প্রথম স্থানে রয়েছেন ফ্রান্সের বার্নার্ড আর্নল্ট, যাঁর সম্পদ ২৩৩ বিলিয়ন ডলার। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছেন ইলন মাস্ক (১৯৫ বিলিয়ন ডলার) এবং তৃতীয় স্থানে জেফ বেজোস (১৯৪ বিলিয়ন ডলার)। মার্ক জাকারবার্গ ১৭৭ বিলিয়ন ডলার নিয়ে চতুর্থ স্থানে রয়েছেন। বিল গেটস ১২৮ বিলিয়ন ডলার নিয়ে সপ্তম স্থানে আছেন এবং ওয়ারেন বাফেট ১৩৩ বিলিয়ন ডলার নিয়ে ষষ্ঠ স্থানে রয়েছেন। ভারতের মুকেশ আম্বানি ১১৬ বিলিয়ন ডলার নিয়ে প্রথম দশে রয়েছেন, এবং গৌতম আদানি ৮৪ বিলিয়ন ডলার নিয়ে ১৭তম স্থানে আছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বেশি বিলিয়নিয়ার রয়েছে, মোট ৮১৩ জন, চীনারা দ্বিতীয় এবং ভারত তৃতীয় স্থানে রয়েছে বিলিয়নিয়ারদের সংখ্যা অনুযায়ী।
ফোর্বস জানায়, তালিকার আপডেট মার্চ ৮, ২০২৪ থেকে স্টক মূল্য এবং মুদ্রার বিনিময় মূল্য ব্যবহার করে, যা প্রতিনিয়ত বিলিয়নিয়ারদের সম্পদের পরিবর্তনকে প্রতিফলিত করে।