সূর্যের আলো পুরো পৃথিবীকে আলোকিত করে। পৃথিবীর রূপ-বৈচিত্র্য আমাদের সামনে দৃশ্যমান করে। তেমনি শিক্ষা থেকে অর্জিত জ্ঞান আমাদের মন ও জীবনকে আলোকিত করে। জন্মের পর একটি শিশুর শিক্ষা গ্রহণের প্রথম পাঠ শুরু হয় তার পরিবারে। কিন্তু তার পরেই তাকে শিক্ষাদানের মহান দায়িত্ব অর্পিত হয় শিক্ষকের ওপর। শিক্ষক তার নিজের অর্জিত শিক্ষা, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা দিয়ে গড়ে তোলেন তার শিক্ষার্থীকে। নিজের সমস্ত জ্ঞান তিনি শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে দেন। এই শিক্ষাদান ও গ্রহণের মধ্য দিয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে গড়ে ওঠে সম্পর্কের এক অটুট বন্ধন।
ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক : যিনি শেখান তিনি শিক্ষক, যিনি শেখেন তিনি শিক্ষার্থী বা ছাত্র। তাই শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে দাতা-গ্রহীতার সম্পর্ক বিদ্যমান। তবে সেই দান ও গ্রহণের বিষয় হলো শিক্ষা ও জ্ঞান। যুগে যুগে যত নবী-রাসুল এসেছেন সবাই শিক্ষক ছিলেন। সব নবী-রাসুল তার অনুসারীদের শিক্ষা দিয়েছেন। তাদের সম্পর্ক ছিল সুমধুর। একজন শিক্ষার্থীর কাছে তার শিক্ষক সর্বোচ্চ সম্মানিত আসনে অধিষ্ঠিত ব্যক্তি। আবার শিক্ষকের কাছে তার শিক্ষার্থীরা সন্তানের মতো প্রিয়। নিজের বিদ্যা-বুদ্ধি ও শ্রম দিয়ে একজন শিক্ষক তার শিক্ষার্থীকে গড়ে তোলেন এবং নিজেকে সেই শিক্ষার্থীর আলোকিত জীবনের গর্বিত অংশীদার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। শিক্ষার্থীরাও তাদের শিক্ষাজীবন এমনকি ব্যক্তিজীবনেরও প্রতিটি পদক্ষেপে, সাফল্যে-ব্যর্থতায় শিক্ষককে স্মরণ করে। শিক্ষক যেমন ছাত্রকে সফল করেন তেমনি ছাত্রের ব্যর্থতার দায়ভারও তিনি নিজের কাঁধে তুলে নেন। তাই ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক হলো সাফল্য-ব্যর্থতা, গ্লানি কিংবা গর্বে সমান অংশীদারত্বের সম্পর্ক।
ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের স্বরূপ : খুব সুন্দর একটি সম্পর্ক হলো ছাত্র ও শিক্ষকের সম্পর্ক। এই সম্পর্ক একই সঙ্গে খুবই সাবলীল, মধুর, স্বতঃস্ফুর্ত আবার গাম্ভীর্যপূর্ণ। শিক্ষক প্রয়োজনে শিক্ষার্থীর ওপর অভিভাবকসুলভ কঠোরতা ও শাসন আরোপ করেন। আবার কখনো বা বন্ধুর মতো ভালোবাসেন, পরামর্শ দেন, উৎসাহ জোগান এবং সব সময়ই পাশে থাকেন। শিক্ষার্থীরা শিক্ষককে অভিভাবকের মতো সম্মান করে, আদেশ-উপদেশ মেনে চলে এবং শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। শিক্ষকের সঙ্গে ছাত্রের সম্পর্ক পথপ্রদর্শক আর পথিকের সম্পর্কের মতো। শিক্ষক পথ দেখান, ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা দেন। আর শিক্ষার্থী সেই দেখানো পথে অগ্রসর হয় এবং নির্দেশনা মেনে চলে। উদারতা, স্নেহ, মায়া, ভালোবাসা আর শাসনের মধ্য দিয়ে একজন শিক্ষক তার শিক্ষার্থীদের ভেতরে স্বপ্নের বীজ বপন করেন। শিক্ষার্থীরা সেই স্বপ্নকে লালন করে।
ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের গুরুত্ব : শিক্ষক হলেন মানুষ গড়ার কারিগর। তাই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষকের সম্পর্ক যত বেশি ভালো হবে, সুন্দর হবে এবং বন্ধুত্বপূর্ণ হবে শিক্ষক তার শিক্ষার্থীকে তত ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারবেন। শিক্ষকের সান্নিধ্যে এসে শিক্ষার্থীরা জীবনকে জানতে, চিনতে ও বুঝতে শেখে। সব কিছুকে নতুন করে দেখতে শেখে। শিক্ষক শিক্ষার্থীর দেখার চোখ খুলে দেন, জ্ঞানের দরজা খুলে দেন। তাদের জ্ঞানের পথে, আলোর পথে নিয়ে যান। শিক্ষক জীবন সম্পর্কে যে দর্শন-চিন্তা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে দেন তার ভিত্তিতেই তারা তাদের জীবনের ব্রত ঠিক করে। একজন ভালো শিক্ষক একজন বখে যাওয়া শিক্ষার্থীকেও সঠিক পথে নিয়ে আসতে পারেন, তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারেন।
সম্পর্ক যেমন ছিল : আগের দিনে ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক ছিল অকৃত্রিম। শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষককে প্রচণ্ড শ্রদ্ধা করত। শিক্ষকের এক একটি আদেশ-উপদেশকে তারা বিনা দ্বিধায় মেনে নিত। শিক্ষকরাও শিক্ষার্থীদের ভালোবাসতেন আপন সন্তানের মতো। শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের নির্দেশনা অলঙ্ঘনীয় মনে করে অক্ষরে অক্ষরে তা পালন করত। শিক্ষকদের সেবা করাও তাদের শিক্ষার অংশ ছিল। শিক্ষকরাও তার শিক্ষার্থীকে সঠিক শিক্ষা দিতে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতেন।
সম্পর্কের বর্তমান প্রেক্ষাপট : ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কে এখন প্রবেশ করেছে কৃত্রিমতা, ব্যক্তিগত স্বার্থ আর লাভের হিসাব। একটা সময় ছিল যখন ছাত্ররা নিজ হাতে শিক্ষকের পা ধুয়ে দিত। আজ সেই হাতে তারা শিক্ষককে লাঞ্ছিত করে। আবার শিক্ষক যে হাত দোয়ায়, উৎসাহে এবং শুভকামনায় ছাত্রের মাথায় রাখতেন, সেই হাতে তারা কোমলমতি শিক্ষার্থীকে বেত্রাঘাতে ক্ষতবিক্ষত করছেন। শিক্ষার্থীরা এখন শিক্ষককে ব্যবহার করতে চায় অসদুপায়ে ভালো ফল লাভের আশায়। অন্যদিকে কিছু কিছু শিক্ষক শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করেন অর্থ লাভের হাতিয়ার হিসেবে। আগে যেখানে শিক্ষকতা মহান পেশা ছিল এখন তা অনেক ক্ষেত্রে ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। ফলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে এখন স্বার্থের সম্পর্ক বিদ্যমান। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ছাত্র-শিক্ষক উভয়ই এখন শিক্ষাঙ্গনের রাজনীতিতে যুক্ত। ফলে সেখানেও তাদের মধ্যে রয়েছে আপসের সম্পর্ক। তবে প্রতিটি ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক এমন নয়। এখনো সৎ শিক্ষক ও ভালো ছাত্ররা আছে। তবে তাদের পরিমাণ দিন দিন কমে যাচ্ছে।
সম্পর্কের অবনতির কারণ : শিক্ষক-ছাত্রের সম্পর্কে যে চরম অবনতির সৃষ্টি হয়েছে তার অন্যতম প্রধান কারণ হলো মানুষের সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, একজন শিক্ষক তার মূল্যবোধকে ভুলে গিয়ে, নীতি-নৈতিকতাকে বিসর্জন দিয়ে ছাত্রদের শুধুমাত্র অর্থ উপার্জনের জন্য ব্যবহার করছেন। ছাত্রদের জিম্মি করে তাদের কাছ থেকে বাড়তি সুবিধা আদায় করছেন। এমনকি শিক্ষার্থীরা তাদের পাশবিকতারও শিকার হচ্ছে। যাকে মানুষ গড়ার কারিগর বলা হয় তিনি তার নীতি ভুলে ছাত্রদের ডিগ্রি লাভের শর্টকাট উপায় বলে দিচ্ছেন। শিক্ষক এবং ছাত্রের মধ্যে নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধের চর্চা নেই। অভিভাবকরাও সচেতন নন। ফলে ছাত্ররা বিনাশ্রমে সর্বোচ্চ ফলাফলের জন্য শিক্ষকের সঙ্গে আঁতাত করছে। শিক্ষক-ছাত্রের লেনদেনের সম্পর্কের কারণে সৃষ্টি হচ্ছে প্রশ্ন ফাঁসের মতো অপরাধ।
শিক্ষকের কাছে প্রত্যাশা : একজন শিক্ষকের কাছে তার শিক্ষার্থীর প্রত্যাশা হলো শিক্ষক তাকে জীবনোপযোগী, যুগোপযোগী শিক্ষা দেবেন। তাকে জ্ঞান অর্জনের পথ দেখাবেন, আলোর পথের যাত্রী করবেন। শিক্ষক তার ছাত্রের ভেতর জ্ঞানলাভের, অজানাকে জানার, অদেখাকে দেখার এবং চেনা-জানা বিষয়গুলোকে নতুন করে চেনার আকাক্সক্ষা সৃষ্টি করে দেবেন, ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা দেবেন। তাদের উৎসাহ, প্রেরণা ও শক্তি জোগাবেন।
ছাত্রের কাছে প্রত্যাশা : শিক্ষক জ্ঞানদাতা, তাই বলে তিনি কেবল দিয়েই যাবেন তা নয়। বরং শিক্ষার্থীর কাছে তারও কিছু প্রত্যাশা থাকে। শিক্ষার্থীর কাছে শিক্ষকের সব চেয়ে বড় প্রত্যাশা হলো শিক্ষার্থীরা তার দেওয়া শিক্ষায় প্রকৃত অর্থেই শিক্ষিত হবে। তার দেখানো পথে চলবে। ছাত্ররা তাকে সম্মান করবে, শ্রদ্ধা করবে, শিক্ষক হিসেবে তার প্রাপ্য মর্যাদা দেবে। শিক্ষক যেমন ছাত্রের অনেক বড় শুভাকাক্সক্ষী তেমনি শিক্ষক প্রত্যাশা করেন তার ছাত্ররাও তাকে ভালোবাসবে, তার প্রতি অনুগত থাকবে।
ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক উন্নয়নে করণীয় : একজন শিক্ষক তখনই সফল হন যখন তিনি নিজ শিক্ষায় তার ছাত্রকে শিক্ষিত করতে পারেন। আর ছাত্রও তখনই সফল হয় যখন সে সেই শিক্ষাকে আত্মস্থ করতে পারে, উপলব্ধি করতে পারে। আর এ জন্য প্রয়োজন ছাত্র ও শিক্ষকের মধ্যে সুসম্পর্ক। কিন্তু বর্তমানে এই সম্পর্ক খুবই নাজুক। তাই এই সম্পর্ক উন্নয়নে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীকে অবশ্যই পরস্পরের ওপর অর্পিত দায়িত্ব-কর্তব্যগুলো যথাযথভাবে পালন করতে হবে। পরস্পরের কাছে যে প্রত্যাশাগুলো রয়েছে সেগুলো পূরণ করতে হবে। কোনো পরিস্থিতিতেই কেউ কারও প্রতি অসদাচরণ করবে না। শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবে। শিক্ষক তাদের প্রতি স্নেহশীল
থাকবেন। অভিভাবকের উচিত সন্তানকে নৈতিক শিক্ষা দেওয়া, যেন তারা শিক্ষককে সম্মান করে সর্বোপরি, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে সবারই উচিত একসঙ্গে কাজ করা।
একজন ভালো শিক্ষক একজন ছাত্রের জীবনের আমূল বদলে দিতে পারেন। তাকে নবজন্ম দিতে পারেন। সম্ভাবনা আর সাফল্যের দুয়ারে পৌঁছে দিতে পারেন। তাই ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের ভিত্তি মজবুত ও দৃঢ় হওয়া প্রয়োজন। স্নেহ-ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা-সম্মানে যে সম্পর্ক রচিত হয় সেই সম্পর্ক যেন সর্বদাই অটুট থাকে। ছাত্র-শিক্ষকের পবিত্র সম্পর্ক অক্ষুন্ন রাখা সবারই নৈতিক দায়িত্ব।