মাদকের গডফাদার হিসেবে পরিচিত কক্সবাজার-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির আশ্রয়দাতা ছিলেন সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ও আসাদুজ্জামান খান। তাই পুলিশ তাকে আইনের আওতায় আনতে চাইলেও আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কারণে তা আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত মঙ্গলবার রাতে চট্টগ্রামে র্যাবের হাতে আটক সাবেক এই সংসদ সদস্য।
মাদক কারবার করে হাজার কোটি টাকার মালিক হওয়া সাবেক এমপি বদিই শুধু আওয়ামী সরকারের আনুকূল্য পাননি, তার স্ত্রীও দুবার এমপি হয়েছেন নৌকা প্রতীকে। কক্সবাজার-টেকনাফ-উখিয়ার ‘অঘোষিত রাজা’ ছিলেন বদি। তার কথায় চলত প্রশাসন।
পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, ৫ বছর আগে মাদক চোরাকারবারিদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয় বদির নাম। এই তালিকায় বদির পরিবারের আরও কয়েকজন সদস্যের নাম রয়েছে। তালিকা থেকে নিজের নাম বাদ দিতে কোটি টাকা খরচ করেন বদি। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সিন্ডিকেটকে বদি এই টাকা দিয়েছিলেন বলে জানিয়েছে ওই সূত্র।
আবদুর রহমান বদি গ্রেপ্তারের পর তার সহযোগীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে আতঙ্ক। বেশিরভাগ সহযোগী চলে গেছেন আন্ডারগ্রাউন্ডে। তার স্ত্রী ও সাবেক এমপি শাহীন আক্তারও চলে গেছেন আত্মগোপনে। তার আপন দুই ভাই ও অন্য স্বজনদের খুঁজছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
সাড়ে ১৫ বছর ধরে কক্সবাজার- টেকনাফের আলোচিত সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদি মাদক কারবারসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িত ছিলেন। বদির পাশাপাশি তার ভাইসহ আত্মীয়-স্বজনরাও জড়িত মাদক কারবারে। আর এসব অভিযোগের কারণে বছর-পাঁচেক আগে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণও করেন তার কয়েকজন স্বজন। তার আপন ছোট ভাই আবদুস শুক্কর ছিলেন আরও বেপরোয়া।
তাছাড়া বদির আরেক ভাই আমিনুর রহমান ওরফে আব্দুল আমিন, শফিকুল ইসলাম প্রকাশ শফিক, ফয়সাল রহমান, ফুফাতো ভাই কামরুল হাসান রাসেল, ভাগ্নে সাহেদ রহমান নিপু ও শামসুল আলম শামীম, চাচাতো ভাই মোহাম্মদ আলম, ভায়রা ভাই জামাল হোসেন, সৈয়দ হোসেন ও সাহেদ কামাল, খালাতো ভাই মং অং থেইন ওরফে মমচি ও মারুফ বিন খলিল ওরফে বাবুকে দিয়ে মাদক কারবার চালাতেন বদি। ইয়াবা কারবার ছিল তাদের আসল ব্যবসা।
ইয়াবা বিক্রির টাকায় সেখানে বাড়ি-গাড়িসহ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন বদি। বদির ভাগ্নে সাহেদ রহমান নিপুর বাবা পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত পরিদর্শক। নিপুর নামও শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীর তালিকায় রয়েছে। এমনকি নিপুর মা শামসুন্নাহারের নামও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার তালিকায় উঠে আসে। বদিসহ পুরো পরিবারের নাম উঠে আসে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাদক কারবারিদের তালিকায়।
পুলিশ সূত্র জানায়, শীর্ষ মাদক কারবারিদের তালিকা থেকে নাম বাদ দিতে বদি যাতায়াত শুরু করেন সাবেক সরকারের শীর্ষ মহলে। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সিন্ডিকেটের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। একাধিকবার আসাদুজ্জামান খানের সঙ্গে বৈঠকও করেন। তাকে আইনের আওতায় আনতে পুলিশ সদর দপ্তর উদ্যোগ নিয়েও ব্যর্থ হন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিন্ডিকেটের কারণে।
এ প্রসঙ্গে পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, ২০১৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি টেকনাফে ১০২ জন শীর্ষ মাদক কারবারির আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে অংশ নিতে চেয়েছিলেন বদি। কিন্তু পুলিশের তৎকালীন মহাপরিদর্শক (আইজিপি) তাতে বাদ সাধেন। তিনি সাফ জানিয়ে দেন, বদি থাকলে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান হবে না। কিন্তু আসাদুজ্জামান খান চেয়েছিলেন বদিকে মঞ্চে রাখতে। আর এই সুযোগে তালিকা থেকে তার নাম বাদ দিতে সিন্ডিকেটের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়ে দেন।
সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য ছিলেন ড. হারুন অর রশীদ ও মনির হোসেন। তাদের সঙ্গে কোটি টাকায় দফারফা করেন বদি। এতে আসাদুজ্জামান খানের সায় ছিল। বিষয়টি ওই সময়কার আইজিপি জানতে পেরে আসাদুজ্জামান খানকে আবারও জানিয়ে দেন বদি অনুষ্ঠানে থাকতে পারবেন না। আইজিপি বিষয়টি শেখ হাসিনাকে অবহিত করলেও তিনি সাড়া দেননি। শেখ হাসিনা আসাদুজ্জামানকে জানিয়ে দেন, বদি যেহেতু আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক এমপি, তাই তালিকা থেকে নাম বাদ দিলেও অনুষ্ঠানে যেতে নিষেধ করবেন। তারপর বদি ওই অনুষ্ঠানে যাননি। তবে ওইদিন অনুষ্ঠানস্থলের আশপাশে ছিলেন।
গতকাল স্থানীয় কয়েক ব্যক্তি জানান, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগ পর্যন্ত এলাকায় দিব্যি দাপটের সঙ্গে চলেছেন বদি। বেশিরভাগ অনুষ্ঠানে এমপির পরিবর্তে তিনিই উপস্থিত থাকেন প্রধান অতিথি হিসেবে। স্ত্রী এমপি হলেও প্রভাব খাটাতেন তিনি নিজে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় তিনি সরকারের পক্ষে মিছিল-সমাবেশ করেছেন। বদি ও তার দলবল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে কাজ করেছেন।
নবম ও দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কক্সবাজার-৪ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন বদি। একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বদির পরিবর্তে তার স্ত্রী শাহীন আক্তারকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেওয়া হয়। তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, কক্সবাজার ও টেকনাফে বদির ইশারা ছাড়া কিছু হতো না। স্ত্রী শাহীন আক্তার এমপি থাকলেও গত ১০ বছরে তার নির্বাচনী এলাকার বিভিন্ন সরকারি বৈঠকে বড়জোর সাত-আটবার উপস্থিত ছিলেন তিনি। বেশিরভাগ বৈঠকে থাকতেন বদি।
বদির বিরুদ্ধে মাদক কারবারের অভিযোগ বিষয়ে পুলিশ ও র্যাবের দুই কর্মকর্তা বলেন, পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে সাইফুল করিমের (পরে ক্রসফায়ারে নিহত) জবানবন্দিতেও সাবেক এমপি বদিসহ অনেকের নাম এসেছিল। জনপ্রতিনিধি, পুলিশ ও সাংবাদিকদের নামও ছিল। মাঝে একসময় বদির সঙ্গে সাইফুল করিমের বিরোধ দেখা দিলে এক পুলিশ কর্মকর্তার মাধ্যমে বিরোধ মিটে যায়।
কক্সবাজারের এক সাবেক পুলিশ সুপার ও চট্টগ্রাম রেঞ্জের এক সাবেক ডিআইজি, কক্সবাজার সদরের সাবেক এক ওসি, টেকনাফ উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান জাফর আহম্মেদ, মনিরুজ্জামান ও তার ভাই আব্দুর গফুর, মৌলভি মজিবুর রহমান, হুন্ডি শওকত ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতের কিছু নেতাকে সহায়তা করেন তিনি। কিছু সাংবাদিককেও তিনি নিয়মিত মাসোহারা দিতেন বলে তারা তথ্য পেয়েছেন।
এদিকে সাবেক এমপি বদিকে গতকাল কক্সাবাজারের আদালতে সোপর্দ করা হয়। টেকনাফ আমলি আদালতের বিচারক হামিমুন তানজিন তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।