পদ্মা ব্যাংকের (একসময়ের ফারমার্স ব্যাংক) সাবেক চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সরাফাত প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাংকটি থেকে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। শেয়ারবাজারে বড় ধরনের অনিয়মে তিনি যুক্ত ছিলেন। ব্যাংকসহ বিভিন্ন খাত থেকে অনিয়মের মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগও আছে তাঁর বিরুদ্ধে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সূত্র এসব কথা জানিয়েছে।
পদ্মা ব্যাংক থেকে নাফিজ সরাফাতের হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ দুদক অনুসন্ধান করছে। সংস্থার প্রধান কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. ইসমাইল হোসেনের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বিশেষ টিম এ নিয়ে কাজ করছে। অনুসন্ধানে অর্থ আত্মসাতের আমলযোগ্য তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে। অনুসন্ধান শেষে শিগগির অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে কমিশনে।
দুদক সূত্র জানায়, নাফিজ সরাফাতের বিরুদ্ধে অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু হয়েছে গত ১০ জুন। ব্যাংক দখল, ঘুষ, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, ঋণ জালিয়াতিসহ আর্থিক অনিয়মের অনেক অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। ব্যাংকসহ বিভিন্ন খাত থেকে আত্মসাৎ করা অর্থ পাচার করে কানাডায় তিনি বাড়ি করেছেন, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটিয়েছেন সেই দেশে। বিগত সরকারের সময় তিনি চলতেন বেশ প্রতাপে। বর্তমানে তিনি পলাতক। এ কারণে তাঁর বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
ফারমার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকার সময় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর ব্যাংকের গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থ হওয়ায় ২০১৭ সালে পদ ছাড়তে বাধ্য হন। তিনি পদত্যাগ করার পর ব্যাংকটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন নাফিজ সরাফাত। এর পর থেকেই নাফিজ প্রতারণা, জালিয়াতি করে বিভিন্ন সময়ে ব্যাংকের টাকা হাতিয়ে নেন। ব্যক্তিগত ও স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে তিনি গত ৩১ জানুয়ারি পদত্যাগ করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়টি অনুসন্ধান পর্যায়ে থাকায় দুদকের কোনো কর্মকর্তা এ নিয়ে বিস্তারিত জানাতে রাজি হননি।
নাফিজ সরাফাতের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ
দুদকের অনুসন্ধানে তথ্য পাওয়া গেছে, নাফিজ সরাফাত ও তাঁর সহযোগীরা বাংলাদেশ ব্যাংকের নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও শীর্ষ ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠান গ্রাম-বাংলা ফার্টিলাইজার কোম্পানিকে ৪০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছেন। সাবেক ফারমার্স ব্যাংকের চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ শাখা থেকে জেসিকা ইন্টারন্যাশনালের অনুকূলে ৬০ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন করে ওই টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। ১৫০ কোটি টাকা পদ্মা ব্যাংকের সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান পদ্মা সিকিউরিটিজের মাধ্যমে নাফিজ সরাফাতের ব্যক্তি নিয়ন্ত্রণাধীন স্ট্র্যাটেজিক ফাইন্যান্সিয়াল গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সরিয়ে নেওয়া হয়। ফ্লোরা সফটওয়্যার লিমিটেড নামে একটি কোম্পানি থেকে ব্যাংকের জন্য ১৩ লাখ ৭৬ হাজার টাকার সফটওয়্যার কেনার ক্ষেত্রে নাফিজ সরাফাত কোম্পানির কাছ থেকে ৮ কোটি টাকা ঘুষ নেন। এক দিনেই কোম্পানির মালিকের চেক ভাঙিয়ে ব্যাংকের ভল্ট থেকে ৫ কোটি টাকা তুলে নেওয়া হয়। পদ্মা ব্যাংকের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান পদ্মা সিকিউরিটিজকে ব্যবহার করে শেয়ারবাজার থেকে ২০০ কোটি টাকা আত্মসাতের প্রমাণ রয়েছে। সাবেক ফারমার্স ব্যাংকের গোপালগঞ্জ শাখার জন্য নাফিজ সরাফাতের মা সাজেদা সরাফাতের কাছ থেকে ৭০ টাকা বর্গফুট হিসাবে ৫ হাজার বর্গফুটের অফিস ভাড়া নেওয়া হয়েছে, যা প্রকৃত ভাড়ার চেয়ে অনেক বেশি। নাফিজ সরাফাত চেয়ারম্যান থাকাকালে ২০১৮ থেকে ২০২৩ সালে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা আত্মসাতের কারণে পদ্মা ব্যাংক দ্বিতীয়বারের মতো বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। তিনি ৫০০ কোটি টাকার একটি অংশ দিয়ে সাউথইস্ট ব্যাংকের শেয়ার কিনেছেন। কৌশলে তিনি নিজের স্ত্রী, সহযোগীসহ তিনজনকে ব্যাংকের পরিচালক পদে বসান। তিনি সাউথইস্ট ব্যাংকের চেয়ারম্যান হওয়ারও চেষ্টা করছেন।
এ ছাড়া অভিযোগ রয়েছে, রাজউকের পূর্বাচল উপশহর প্রকল্পে একটি প্লট নিয়মবহির্ভূতভাবে কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশকে দেওয়া হয়। পদ্মা ব্যাংকের আগে আইএফআইসি ব্যাংক ও আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক বিপর্যয়ের ঘটনায় জড়িত ছিলেন নাফিজ সরাফাত। ২০১৪ থেকে ২০১৭ সালে ফারমার্স ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতির মাধ্যমে ৩২৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন তিনি। ভুয়া ঋণ আদায়ের জন্য মামলা করে ৫ কোটি টাকা আইনজীবীর ফি হিসেবে আত্মসাৎ করা হয়। নিয়মবহির্ভূতভাবে নিজ ও পরিবারের নামে অফিস ভাড়া ও অগ্রিম হিসাবে ২৫ কোটি টাকা নিয়েছেন ব্যাংক থেকে। এ ছাড়া রুগ্ণ পদ্মা ব্যাংকে নাফিজ সরাফাত সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এহসান খসরুর সঙ্গে যোগসাজশে ২০০ কর্মচারী নিয়োগ দেন। এসব নিয়োগের জন্য ৫ থেকে ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ নেওয়া হয়।
নাফিজ সরাফাতের ভগ্নিপতি ফারমার্স ব্যাংকের গাজীপুরের মাওনা শাখার ম্যানেজার শেখ কামরুল হোসেন শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ জালিয়াতির মাধ্যমে চাকরি নেন বলে অভিযোগ রয়েছে। কামরুল এই শাখা থেকে প্রায় ২০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। ব্যাংকের নিয়মভঙ্গ করে শাহি ট্রেডার্সের মালিক বাদশা মিয়ার নামে ১ কোটি ৬০ লাখ টাকার ভুয়া ঋণ পাস করিয়ে সেই টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। সরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইসিবির শেয়ারহোল্ডারশিপ বিক্রি বাবদ দুটি পে-অর্ডারের মাধ্যমে ফারমার্স ব্যাংকের নামে ১৫ কোটি টাকা প্রদান করা হয়। ওই পে-অর্ডার প্রিমিয়ার ব্যাংকের বনানী শাখায় নগদায়ন করে ১৫ কোটি টাকা কর্মকর্তারা নিজেদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করেছেন। শেখ কামরুল ও তাঁর স্ত্রী আনিসা চৌধুরীর যৌথ অ্যাকাউন্টে গ্রাহকের ঋণ হিসাব থেকে তার অজ্ঞাতসারে টাকা আত্মসাতের তথ্যও রয়েছে দুদকের হাতে। মাওনা শাখা থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে প্রায় ২০১ কোটি টাকা অনিয়মিত ঋণ বিতরণ হয়েছে। করোনাকালে শেখ কামরুল নিরাপদে কানাডায় চলে যান। নাফিজ সরাফাতের বিরুদ্ধে অভিযোগ গুলোর মধ্যে রয়েছে– তাঁর ভগ্নিপতি কামরুল জাল সার্টিফিকেট দিয়ে চাকরি নেওয়ার পর পর্যাপ্ত অভিজ্ঞতা না থাকলেও তাঁকে ব্রাঞ্চ ম্যানেজার হিসেবে পদোন্নতি দিয়েছেন।
সিন্ডিকেট করে দুর্নীতি
সূত্র জানায়, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ, ছাগলকাণ্ডে আলোচিত এনবিআরের সাবেক সদস্য মতিউর রহমান ও চৌধুরী নাফিজ সরাফাত সিন্ডিকেট করে দুর্নীতি করতেন। ফারমার্স ব্যাংকে নাফিজ সরাফাতের চেয়ারম্যান হওয়ার পেছনে বেনজীর আহমেদ ভূমিকা রেখেছেন। ওই সময় বেনজীর র্যাবের মহাপরিচালক ছিলেন।