শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন কেন্দ্র করে সৃষ্ট পরিস্থিতির প্রভাব পড়েছে প্রবাসী আয়ে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘রেমিট্যান্স শাটডাউন’ প্রচারণা চালাচ্ছেন অনেক প্রবাসী। এ ছাড়া কারফিউ ও ইন্টারনেট বন্ধের প্রেক্ষাপটে চলতি জুলাইয়ে রেমিট্যান্স প্রবাহ অনেক কমে গেছে। গত জুন মাসে যে পরিমাণ রেমিট্যান্স এসেছে, জুলাইয়ের শেষের দিকে তা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, জুলাই মাসের ২৭ তারিখ পর্যন্ত প্রতিদিন গড়ে রেমিট্যান্স এসেছে ৫ কোটি ৭৭ লাখ মার্কিন ডলার। যেখানে গত জুন মাসে এসেছিল প্রতিদিন ৮ কোটি ৪৬ লাখ ডলার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে রেমিট্যান্স প্রবাহ আরও কমতে পারে। এতে অর্থ পাচার ও অবৈধ লেনদেন বাড়বে, যা দেশের অর্থনীতির জন্য বড় অশনিসংকেত।
বিদেশি মুদ্রার বাজারে স্থিতিশীলতা ফেরাতে গত ৮ মে ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতি চালুর পর ডলারের দর এক লাফে ৭ টাকা বেড়ে ১১৭ টাকা হয়। দুই মাসের বেশি সময় ধরে ডলারের দর ১১৭ থেকে ১১৮ টাকায় স্থিতিশীল আছে। দাম বাড়ায় রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়তে থাকে। টানা তিন মাস ধরেই রেমিট্যান্স ২০০ কোটি ডলারের বেশি এসেছে। এর মধ্যে জুন মাসে ২৫৪ কোটি ডলারেরও বেশি আসে, যা একক মাস হিসেবে দেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। কিন্তু ছন্দপতন হয় জুলাই মাসে। কোটা আন্দোলন কেন্দ্র করে দেশব্যাপী বিশৃঙ্খলা, হত্যার পাশাপাশি ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় প্রায় এক সপ্তাহ রেমিট্যান্স পাঠাতে পারেননি প্রবাসীরা। এ ছাড়া কোটা আন্দোলন দমনে সরকারি পদক্ষেপে নাখোশ প্রবাসীদের অনেকেই বৈধপথে রেমিট্যান্স না পাঠানোর কথা বলছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। যার প্রভাব ইতিমধ্যেই পড়তে শুরু করেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি জুলাইয়ের ১ থেকে ২৭ তারিখ পর্যন্ত ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী আয় এসেছে ১৫৬ কোটি ৭৪ লাখ ডলার বা ১৮ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ১১৮ টাকা ধরে)। সে হিসেবে প্রতিদিন এসেছে ৫ কোটি ৭৭ লাখ ডলার। এর মধ্যে ১ থেকে ৬ জুলাই পর্যন্ত এসেছে ৩৭ কোটি, ৭ থেকে ১৩ জুলাই ৬০ কোটি ও ১৪ থেকে ২০ জুলাই ৪৫ কোটি। আন্দোলনের তীব্রতা ও সরকারের কঠোর পদক্ষেপের পর ২১ থেকে ২৭ জুলাই পর্যন্ত এসেছে মাত্র ১৩ কোটি ডলার।
চলতি মাসে রেমিট্যান্স কমে যাওয়ার বিষয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর দেশ রূপান্তরকে বলেন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন পরিস্থিতির কারণে রেমিট্যান্স কম আসাটা স্বাভাবিক। তবে প্রবাসীদের যে প্রচারণার কথা শোনা যাচ্ছে, সেটা বাস্তবায়ন অর্থ পাচারকারীরা সক্রিয় হয়ে উঠবে। প্রবাসীরা পরিবারের কাছে অর্থ পাঠাবেই, এখন যদি সেটা ব্যাংকিং চ্যানেলে না পাঠালে অন্য কোনোভাবে পাঠায় তবে অর্থ পাচার বেড়ে যাবে, যা আমাদের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, চলতি মাসের শুরুতে রেমিট্যান্স প্রবাহ অনেকটা স্বাভাবিক থাকলেও ২১ তারিখের পরে অস্বাভাবিক পতন লক্ষ করা গেছে। ২০ তারিখ পর্যন্ত প্রতিদিনের গড় রেমিট্যান্স ছিল প্রায় ৭ কোটি ডলার। ২১ জুলাই থেকে ২৭ জুলাই পর্যন্ত প্রতিদিন গড়ে ২ কোটি ডলারও রেমিট্যান্স আসেনি। অবশ্য ইন্টারনেট বন্ধ থাকার কারণেও রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যেতে পারে বলেও ব্যাংকাররা জানিয়েছেন। তবে রেমিট্যান্স গ্রহণে সমস্যা থাকলেও এ সময়ে রেমিট্যান্স প্রেরণে কোনো বাধা ছিল না।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, জুলাই মাসের ২৭ তারিখ পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে ২২ কোটি ৬৮ লাখ ডলার, বিশেষায়িত একটি ব্যাংকের মাধ্যমে ৮ কোটি ৬৪ লাখ, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে ১২৪ কোটি ৯৮ লাখ এবং বিদেশি ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে এসেছে ৪২ লাখ ৯০ হাজার মার্কিন ডলার।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ১৯৭ কোটি ৩১ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স এসেছিল। এরপর ডলারের বিপরীতে টাকার ধারাবাহিক অবমূল্যায়নের কারণে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে প্রতি মাসে প্রায় ২০০ কোটি বা তারচেয়ে বেশি পরিমাণের রেমিট্যান্স আসছে দেশে। তবে জুলাইতেই এর ছন্দপতন হতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে সর্বমোট ২ হাজার ৩৯২ কোটি ডলারের সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। দেশীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ ২ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকা। রেমিট্যান্সের এ অঙ্ক এ যাবৎকালের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আহরণ। দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রেকর্ড রেমিট্যান্স এসেছিল ২০২০-২১ অর্থবছরে, সেবার এসেছিল ২ হাজার ৪৭৭ কোটি ডলার।
এদিকে রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে সম্প্রতি বেশি রেটে রেমিট্যান্স আনতে মৌখিক নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সংস্থাটির একজন প্রভাবশালী ডেপুটি গভর্নর রবিবার বেশি রেমিট্যান্স আহরণ করে এমন ১২টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে (এমডি) এ নির্দেশ দিয়েছেন। ‘ক্রলিং পেগ’ চালুর পর ব্যাংকগুলোতে ডলার রেট সর্বোচ্চ ১১৮ টাকা হলেও গত রবিবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মৌখিক নির্দেশের পর বেশ কয়েকটি ব্যাংক রেমিট্যান্স কেনার রেট ১১৮ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ১১৮ টাকা ৭০ পয়সা অফার করছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি বেসরকারি ব্যাংকের এমডি জানান, গত এক সপ্তাহ দেশে ইন্টারনেট ছিল না। ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম হয়নি। সারা বিশ্বের সঙ্গে আর্থিক লেনদেন প্রায় বন্ধ ছিল। তাই রেমিট্যান্স সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। তাই আজ থেকে ডলারের রেট বাড়িয়ে দিয়ে রেমিট্যান্স সংগ্রহের চেষ্টা করা হচ্ছে।
এসব বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ব্যাংক তো কয়েক দিন বন্ধ ছিল। ইন্টারনেটও বন্ধ ছিল। গত সপ্তাহের বুধ ও বৃহস্পতিবার সীমিত পরিসরে ব্যাংক চলেছে। ইন্টারনেট বন্ধ থাকার কারণে প্রবাসীরা পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি। এজন্য কিছুটা কমতে পারে। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রবাসীদের ‘রেমিট্যান্স শাটডাউন’ প্রচারণা চলছে, আমরা আশা করছি রেমিট্যান্স পাঠানোর ক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়বে না।