আমরা জানি, ব্যাংক শিল্প অত্যন্ত সংবেদনশীল খাত। সমাজ-সংসারের কোনো না কোনো ক্ষেত্রে জড়িয়ে থাকে ব্যাংক। দেশের সেই ব্যাংক শিল্পের বর্তমান অবস্থা দৃশ্যত ভালো নয়। অগ্রগতি ও উত্থান পর্যায় পার হয়ে এখন যেন পতনমুখী প্রায়। গেল বছরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা।
এরই মধ্যে পারফরম্যান্স অনুযায়ী ব্যাংকগুলোকে সবুজ, হলুদ ও লাল– তিনটি জোনে ভাগ করা হয়েছে। লাল অর্থাৎ সবচেয়ে দুর্বল-খারাপ, হলুদ হলো দুর্বল এবং সবুজ অর্থাৎ ভালো ব্যাংক। সে অনুযায়ী সবুজ জোনে রয়েছে আটটি বিদেশিসহ মোট ১৬টি ব্যাংক। হলুদ জোনে আছে ২৯, আর লাল জোনে আছে ৯টি এবং ৩টি ব্যাংক লাল জোনের খুব কাছাকাছি। অর্থাৎ বলা যায়, ১২টি ব্যাংকের অবস্থা খুবই নাজুক। মোট খেলাপি ঋণের ৯০ হাজার কোটি টাকা বা ৬২ শতাংশ এই ১২টি নাজুক ব্যাংকের দেওয়া। আর ব্যাংক শিল্প গড়ের তুলনায় হলুদ জোনে থাকা ব্যাংকগুলোর অবস্থা গড় রেখার নিচে। ফলে হলুদ জোনের ব্যাংকগুলোকে দুর্বল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। উল্লেখ্য, মোট ৫৪টি ব্যাংকের আর্থিক কর্মক্ষমতা বিচার-বিশ্লেষণ করে উপরোক্ত ক্যাটেগরি করা হয়। তথ্যে ত্রুটি এবং অপর্যাপ্ততার কারণে সাতটি ব্যাংককে ওই ক্যাটেগরি নির্ণয়ে বিবেচনা করা হয়নি।
মনে রাখতে হবে, এমন ব্যাংকও আজকে ভালো ব্যাংকের তালিকায় আছে, যেসব ব্যাংকের উদ্যোক্তারা মাত্র ২০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে পরিচালক হয়ে এ শিল্পে ব্যবসা করে শত শত কোটি টাকা মুনাফা করেছেন এবং ব্যাংকের মূল্যমানও হাজার হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। তাহলে যে ব্যাংক শিল্প থেকে উদ্যোক্তারা এত শত কোটি টাকার লভ্যাংশ নিয়েছেন, সেই শিল্পের দুর্দিনে এগিয়ে আসতে অনীহা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তা ছাড়া আজকে যে ব্যাংকটি গ্রিন জোনে আছে, ভবিষ্যতে যে তা রেড জোনে যাবে না, এর কোনো নিশ্চয়তা আছে? অধিকন্তু, অতি দুর্বল ব্যাংকগুলোর ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিলে এগুলো ব্যাংক শিল্পে একসময় সিস্টেমিক ঝুঁকির কারণ হয়ে যেতে পারে। তখন ভালো-দুর্বল সব ব্যাংকের ওপরই নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সুতরাং শিল্পের স্বার্থ সর্বাগ্রে।
প্রশ্ন উঠছে, একীভূত হয়ে যাওয়া ব্যাংকের ঋণখেলাপিরা এ ক্ষেত্রে বিজয়ী বা পার পেয়ে যেতে পারে। অথচ মূলত এই ঋণখেলাপিদের কারণেই ব্যাংকটিকে একীভূত হতে হলো। এখানে বলা যায়, ঋণখেলাপিদের কারণেই একটি ব্যাংক দুর্দশাগ্রস্ত হয়। তবে একীভূত হওয়ার কারণে ঋণখেলাপিরা বিজয়ী হয়ে যাবে– এ কথা ঠিক না। একটি ব্যাংক একীভূত হওয়ার পরও কথিত খেলাপি ঋণ আদায়ের প্রক্রিয়া চলমান থাকবে। কারণ গ্রহীতা ব্যাংক দায়, দেনা, সম্পদসহ একটি টার্গেট ব্যাংককে একীভূত করে নেয়। উল্লেখ্য, অবলোপন করে দেওয়ার পরও খেলাপি ঋণ আদায়ের প্রক্রিয়া চলমান থাকে এবং এ ক্ষেত্রে যা আদায় হবে তা সরাসরি ব্যাংকের মুনাফায় যোগ হবে।

ভালো ব্যাংকের সঙ্গে দুর্বল ব্যাংক একীভূত হলে দুর্বল ব্যাংকের নিয়মিত ঋণগ্রহীতা বা ভালো ব্যাংকের নিয়মকানুন, মনিটরিং পূর্বসতর্কীকরণ প্রক্রিয়ার অধীনে চলে আসবে। ভালো ব্যাংকের দক্ষ ব্যবস্থাপনায় টার্গেট ব্যাংক থেকে আসা ঋণগ্রহীতারাও ভালো গ্রাহকে পরিণত হয়ে যাবে– এটাই প্রত্যাশা। এ ক্ষেত্রে অনেকে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের ব্যর্থতার কথা উদাহরণ হিসেবে বলে থাকেন। অতীতের ব্যর্থতার ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে অগ্রসর হওয়া বাঞ্ছনীয়। অতীতের ব্যর্থ ঘটনা দেখে থেমে যাওয়া কোনো যুক্তির কথা হতে পারে না। পেশাদারিত্বের সঙ্গে ব্যাংক একীভূত করলে সাফল্যের সম্ভাবনাই বেশি। তবে অনিশ্চয়তা থাকবে। এই অনিশ্চয়তার সঙ্গে মিশে আছে অপার সম্ভাবনা। তাই এই অনিশ্চয়তা এড়িয়ে চলার অর্থই সম্ভাবনার পথ এড়িয়ে চলা। এমনও প্রশ্ন উঠেছে, একটি ভালো ব্যাংক দুর্বল ব্যাংকের দায় কেন নেবে? সমকালে প্রকাশিত আমার আগের নিবন্ধগুলোতে (১৯, ২০, ২১, ২৩ মার্চ ২০২৪) বলেছি, একীভূতকরণ ও অধিগ্রহণ একটি ব্যবসায়িক কৌশল। এতে ব্যবসা সম্প্রসারণের সম্ভাবনা রয়েছে। এই সম্ভাবনার ফসল ঘরে তুলতে গেলে প্রাথমিক পর্যায়ে একটু বেগ পেতে হতে পারে। এটাকে বোঝা বা দায় মনে করলে চলবে না। একীভূতকরণ বা অধিগ্রহণের প্রস্তাবটি বার্ষিক সাধারণ সভা বা বিশেষ বার্ষিক সভায় পাস করানোর বিষয়টি নিয়েও সমস্যা হওয়ার কথা না। পেশাদারিত্বের সঙ্গে অগ্রসর হয়ে ব্যবসায়িক কৌশল হিসেবে একীভূতকরণের প্রস্তাব উপস্থাপন করা হলে সব শেয়ারহোল্ডারই পক্ষে ভোট দেবে বলে আশা করা যায়। তা না হলে মালয়েশিয়ার ৫৪টি ব্যাংক একীভূত হয়ে ১০টি ব্যাংক হলো কীভাবে? এ দেশের ব্যাংকাররা ভিন্ন গ্রহের কেউ না। তাই এখানেও এই একীভূতকরণ সম্ভব।
একটি কথা স্পষ্ট করে বলা দরকার, একীভূতকরণ বা অধিগ্রহণ যাই হোক, ঋণখেলাপিদের ছাড় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এই ঋণখেলাপিরাই ব্যাংক শিল্পের দুর্দশার জন্য অধিকাংশে দায়ী। এই খেলাপিদের কঠিনভাবে মোকাবিলা করতে হবে। তারা দেশের ভালো ভালো ব্যবসায়ীকেও বিপাকে ফেলেছে। তাদের কারণে ব্যাংক সুদ বেড়েছে। বড় বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের পরিচালন ব্যয় বেড়েছে। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের চিহ্নিত করে তাদের ব্যাপারে কঠোর হতে হবে।
অবশ্য ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধন) আইন, ২০২৩-এর অধীনে এ ব্যাপারে বিধান রাখা হয়েছে। তা ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক গত ১২ মার্চ ঋণগ্রহীতা শনাক্তকরণ ও ইচ্ছাকৃত খেলাপি চূড়ান্তকরণ এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ প্রসঙ্গে একটি সার্কুলার জারি করেছে।
ড. মো. তাবারক হোসেন ভূঁঞা : হেড অব চেম্বার, জুরিস কনসাল্টস, অ্যান্ড লিগ্যাল সলিশনস (জেএলএস)