দেশের এক কোণে বিস্তৃত অনুর্বর জমি। চারপাশে ধূ ধূ মরুভূমি। বালি, কড়া রোদ আর নোনা পানি ছাড়া কিছুই ছিল না সেই জমিতে। এবার সেই জমিরই রূপ বদল করতে চলেছেন সৌদি আরবের যুবরাজ। প্রকল্পের পরিকল্পনা প্রকাশ করা হয়েছে।
সৌদির যুবরাজ মহম্মদ বিন সালমনের স্বপ্ন, মরুভূমির মাঝে আস্ত একটা ‘জাদুর শহর’ গড়ে তোলার। সেখানে থাকবে বিলাসবহুল রিসোর্ট, হোটেল, ভাসমান পরিকাঠামো, কৃত্রিম সমুদ্রের মাঝে আস্ত দ্বীপ। পশ্চিম এশিয়ায় মরুভূমির মাঝে এমন জনপদ গঠন যদিও নতুন নয়।
মরুভূমির মাঝে এই ‘ইউটোপিয়া’-র নাম দেয়া হয়েছে নিওম। ১৪ হাজার ২০০ বর্গমাইল জুড়ে গড়ে উঠতে চলেছে সেই আধুনিক শহর। তার মধ্যে থাকছে ১২টি প্রকল্প।
কী নেই নিওমে! দুনিয়ার সব থেকে বড় ভাসমান পরিকাঠামো, সিহর্স আকৃতির দ্বীপ, যেখানে থাকবে বিলাসবহুল রিসোর্ট, বন্দর, পাহাড়ের খাঁজে হোটেল, বহুতল। তৈরি হবে প্রযুক্তি হাব।
সৌদির যুবরাজের আশা, এর ফলে দেশে পর্যটকের আগমন বৃদ্ধি পাবে, অর্থনীতি মজবুত হবে।
রিপোর্ট বলছে, প্রকল্পগুলোর খরচ ৫০ হাজার কোটি ডলার থেকে এক লাখ কোটি ডলার হতে পারে।
২০২১ সালে ‘দ্য লাইন’ প্রকল্পের ঘোষণা করে সৌদি সরকার। এই প্রকল্পে দু’টি সমান্তরাল বহুতল তৈরি হবে যাদের দৈর্ঘ্য ১৭০ কিলোমিটার। একটির উচ্চতা ২৭৫ মিটার, দ্বিতীয়টির ২২৫ মিটার। দু’টি বহুতলের মধ্যে সংযোগ রক্ষার জন্য থাকবে ঝুলন্ত সেতু।
সেই ঝুলন্ত সেতুতে চলবে ট্রেনও। এক সাথে এই জোড়া টাওয়ারে ৯০ লাখ মানুষ বাস করতে পারবে। আবাসনের পাশাপাশি বহু অফিসও থাকবে দুই বহুতলে।
জনপদে কোনো রাস্তা থাকবে না। চলবে না গাড়ি। দোকান, বাজার থাকবে পাঁচ মিনিটের দূরত্বে। ড্রোন, রোবট, ভোলোকপ্টার জিনিসপত্র পৌঁছে দেবে। পুরো জনপদে আলো জ্বলবে, যান, যন্ত্র চলবে পুনর্ব্যবহারযোগ্য শক্তির মাধ্যমে।
মরুভূমিতে এমনিতে বৃষ্টির দেখা মেলে না। তবে নিওমে মেঘ তৈরির জন্য যন্ত্র থাকবে। প্রয়োজন মতো বৃষ্টি উৎপন্ন করানো হবে। আকাশে সব সময়ই থাকবে কৃত্রিম চাঁদের আলো। বহুতলের বাসিন্দাদের জিনের উন্নয়ন ঘটানোর জন্যও গবেষণা চলবে নিওমে। সেই মতো চিকিৎসকেরা পদক্ষেপ করবেন। একাধিক মিশেলিন স্টার রেস্তোরাঁ থাকবে, যেখানে নানা রকম খাবার চেখে দেখার সুযোগ পাবে বাসিন্দারা।
নিওমে রয়েছে বহুতল ‘অ্যাকোয়েলাম’। ওয়েবসাইট থেকে জানা গেছে, পাহাড় কেটে তৈরি করা হচ্ছে এই বিলাসবহুল বহুতল। বাইরে থেকে দেখে মনে হবে, আস্ত একটা পাহাড় দাঁড়িয়ে রয়েছে। লোহিত সাগরের আকাবা উপকূলে থাকছে প্রবেশপথ। সেখান দিয়ে বাসিন্দারা প্রবেশ করবে অ্যারোয়েলামে।
সিহর্স আকৃতি বিশিষ্ট কৃত্রিম দ্বীপও তৈরি করা হচ্ছে নিওমে। নাম ‘সিন্দালাহ’। আয়তন আট লাখ ৪০ হাজার বর্গমিটার। এখানে থাকবে বিলাসবহুল কিছু রিসোর্ট। সেখানে থাকা সকলের সাধ্যে কুলাবে না। ২০২৫ সাল নাগাদ শেষ হবে প্রকল্পের কাজ।
দ্বীপে সমুদ্রের পাশে থাকবে একটি ক্লাব। নাম ‘জেনর’।
চারপাশে থাকবে কৃত্রিম জঙ্গল। ২০২৬ নাগাদ শেষ হবে ‘ট্রোজেনা’ প্রকল্পের কাজ। তাবুক অঞ্চলের উচ্চতম পাহাড়ের মাথায় তৈরি হবে প্রকল্প। সেখানে থাকবে স্কি করার জায়গা। ২০২৯ সালের এশিয়ান উইন্টার গেমস হবে এখানেই।
নিওমে থাকবে অভয়ারণ্য। তার চারপাশে থাকবে তিনটি বিলাসবহুল হোটেল। এই প্রকল্পের নাম ‘জারদুন’।
পরিবেশবিদেরা এই প্রকল্প নিয়ে ইতোমধ্যেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাদের অভিযোগ, নিওমের কারণে স্থানীয় বাস্তুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। মরুভূমির এই পথ দিয়ে যাতায়াত করে পরিযায়ী পাখিরা। বহুতল গড়ে উঠলে তারা পথ ভুল করতে পারে।
রিপোর্ট বলছে, প্রতিবছর শরৎকালে ইউরোপ থেকে আফ্রিকা যায় প্রায় ১০০ প্রজাতির ২১০ কোটি পরিযায়ী পাখি। সৌদির তাবুক অঞ্চল দিয়েই আফ্রিকা যায় তারা। নিওম তৈরি হলে পরিযায়ী পাখিদের পথে বাধা আসতে পারে। বহুতলে ধাক্কা খেয়ে বিপত্তিও ঘটতে পারে। এমনটাই আশঙ্কা করছেন পক্ষীবিদেরা।
মানবাধিকার সংগঠগুলোর দাবি, ওই প্রকল্প তৈরির জন্য হোয়েইতাত জনজাতিদের ঘরছাড়া করা হয়েছে। তাদের সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার। একটি মানবাধিকার সংগঠনের দাবি, হোয়েইতাত জনজাতির তিনজনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে সে দেশের প্রশাসন।
সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা