সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অনেক কড়া নজরদারির মধ্যেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ও টেলিগ্রামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র বিক্রির বিজ্ঞাপন দেখা যায়। বিষয়টি জানতে পেরেই শাহবাগ থানায় মামলা দায়ের করে প্রশাসন। সেই মামলার তদন্ত করতে গিয়ে আন নাফিউল ওরফে নাফিজ ইকবাল নামে প্রতারক চক্রের এক সদস্যকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
ডিবি-সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (উত্তর) বিভাগের ওয়েব বেজড ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিমের এডিসি আশরাফউল্লাহর নেতৃত্বে একটি দল অভিযান পরিচালনা করে তাকে গ্রেপ্তার করে। এ সময় উদ্ধার করা হয় প্রতারণায় ব্যবহৃত আলামতও।
একই সময় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাইবার সিকিউরিটি ইনচার্জ পরিচয় দিয়ে শিশু বিশেষজ্ঞ ও সাইবার টিনস ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা মো. সাদাত রহমানের (২১) নামে ফেক আইডি ব্যবহার করে প্রশ্নপত্র বিক্রির অভিযোগে মো. আসিফ তালুকদার নামে এক যুবককে গ্রেপ্তার করে ডিবি-সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (উত্তর) বিভাগ।
ডিবি পুলিশ বলছে, এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা প্রশ্ন ফাঁস না হলেও ভুয়া প্রশ্নপত্র সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দিয়ে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের চেষ্টা ও প্রতারণা করেছেন নাফিজ। একইভাবে প্রতারণামূলকভাবে ফেক আইডি খুলে ভুয়া প্রশ্নপত্র বিক্রির নামে অর্থ আত্মসাৎ করেছেন আসিফ। এসব প্রতারণায় সচেতনতার বিকল্প নেই।
ডিবি পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ভুয়া প্রশ্নপত্র ফাঁসের নামে সোশ্যাল মিডিয়ায় বিজ্ঞাপন প্রচারের অভিযোগ তুলে সাইবার নিরাপত্তা আইনে গতকাল শাহবাগ থানায় একটি মামলা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। মামলার নম্বর-৩৭।
রোববার (২৫ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে নিজ কার্যালয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপির) অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, মামলার পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি দ্রুত বিবেচনায় নিয়ে জড়িত প্রতারককে আইনের আওতায় আনতে বগুড়া জেলার শিবগঞ্জ থানাধীন দবিলা সংসারদিঘী গ্রাম থেকে আন নাফিউল নাফিজ ইকবালকে (২৩) গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি জয়পুরহাট জেলার পাঁচবিবি রাথাবাড়ীর সবুজ আহমেদের ছেলে।
হারুন বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র সরবরাহের কথা বলে বিভিন্ন গ্রুপে প্রচার এবং বিভিন্ন গ্রুপের পোস্টে কমেন্ট করে পরীক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করেন। পরীক্ষার্থীরা সহজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র পাওয়ার আশায় অপরাধীদের দেওয়া টেলিগ্রাম নম্বরে এবং ফেসবুক আইডির মেসেঞ্জারে যোগাযোগ করলে, তারা তাদের দেওয়া বিকাশ নম্বরে আগে ২০ হাজার টাকা পাঠানোর পর প্রশ্ন দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয়। যদিও টাকা পাঠানোর পর তারা যোগাযোগ বন্ধ করে দিত।
গ্রেপ্তার নাফিজ সম্পর্কে তিনি বলেন, নাফিউল নাফিজ মহিপুর হাজী মহসিন কলেজে অনার্স ২য় বর্ষে অধ্যয়নরত। প্রশ্নপত্র বিক্রির নামে প্রতারণামূলকভাবে তিনি প্রায় ১০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
অন্যদিকে শিশু বিশেষজ্ঞ ও সাইবার সাইবার টিনস ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা মো. সাদাত রহমানের নাম ব্যবহার করে প্রতারণা সম্পর্কে হারুন বলেন, সাদাত রহমান নামে তরুণ শিশু সাইবার অপরাধ নিয়ে কাজ করেন। তিনি আইসিটি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গেও কাজ করেন। আন্তর্জাতিকভাবে তিনি নানা পুরস্কারও পেয়েছেন। তার নামে ফেক আইডি খুলে প্রশ্নপত্র ফাঁস থেকে শুরু করে নানা অপরাধ কর্মকাণ্ড চলছিল। ফেক আইডির ব্যবহারকারী অপরাধী নিজেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাইবার সিকিউরিটি ইনচার্জ হিসেবেও পরিচয় দিয়ে আসছিলেন। আইসিটি মন্ত্রণালয় থেকে করা অভিযোগ ও ভুক্তভোগী সাদাত রহমানের মামলার পরিপ্রেক্ষিতে প্রতারণায় জড়িত আসিফ তালুকদারকে (১৮) গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে সাইবার টিনস ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সাদাত বলেন, কাজের সুবাদে প্রধানমন্ত্রী, সাবেক শিক্ষামন্ত্রীসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে তোলা ছবি আমার ফেসবুক থেকে সংগ্রহ করে এসএসসি পরীক্ষার্থীদের দেখিয়ে বলা হয়েছে, আমি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাইবার সিকিউরিটি অফিসার এবং প্রশ্ন ফাঁসের কথা বলে বিভ্রান্ত করে বিকাশ ও নগদ নম্বরে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে প্রতারক চক্রটি। এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে মামলা দায়ের করি।
তিনি বলেন, অবাক হলাম, আমি নিজে সাইবার সচেতনতায় পুলিশ প্রশাসন, মন্ত্রণালয়, স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করছি। সেখানে আমি নিজেই ভুক্তভোগী। আমার নামেই প্রতারণা করা হচ্ছে। যারা ইন্টারনেট ব্যবহার করেন, তাদের সচেতন হতে হবে। হুট-হাট বিশ্বাস করা যাবে না। লোভে পড়ে কখনো অনলাইনে কাউকে টাকা দেওয়া যাবে না। লেনদেনে সতর্ক থাকতে হবে।
গ্রেপ্তার আসিফ তালুকদার সম্পর্কে ডিবি প্রধান হারুন বলেন, আসিফ তালুকদার ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করার সুযোগ পেলেও প্রতারণায় পিছিয়ে নেই। ফেক ফেসবুক আইডি ব্যবহার করে প্রতারণা ও প্রশ্ন বিক্রির নামে অর্থ আত্মসাৎ করেছেন তিনি। তিনি ছদ্মবেশ ধারণ করে অন্যের ছবি ও পরিচয় ব্যবহার করে ফেক ফেসবুক আইডি তৈরি করে। ফেক ফেসবুক আইডিতে সাইবার টিনস ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতার পরিচয় ব্যবহার করে নিয়মিত ছবি পোস্ট করত এবং ভুক্তভোগীর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর ও সাবেক শিক্ষামন্ত্রীর ছবি পোস্ট করে সাধারণ মানুষের বিশ্বাস অর্জন করে। তিনি নিজেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাইবার সিকিউটিরি ইনচার্জ পরিচয় দিতেন। ফেসবুক আইডিতে এসএসসি পরীক্ষার (বিগত সালের) প্রশ্ন পোস্ট করে এবং ফেক ফেসবুক আইডিতে দ্রুত যোগাযোগ করতে বলে। এরপর তার পোস্ট দেখে যারা যোগাযোগ করত তারাই প্রতারিত হতো।
হারুন পরামর্শ দিয়ে বলেন, যেকোনো পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করা খুবই দুঃসাধ্য কাজ। সুতরাং ফাঁস করা প্রশ্ন ক্রয়-বিক্রয় থেকে বিরত থাকুন এবং এ সংক্রান্ত আর্থিক লেনদেন থেকে সম্পূর্ণভাবে বিরত থাকুন। অবৈধ পন্থা অবলম্বন করে যে কোনো পরীক্ষায় অংশগ্রহণের মনোভাব থেকে সকলকে বের হয়ে আসতে হবে। অভিভাবকদের এই বিষয়য়ে সচেতন হতে হবে। এই ধরনের অবৈধ চক্রের সন্ধান পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকে অবগত করা হলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ সহজ হবে।