বছরের পর বছর ধরে ইরান সমর্থিত ইয়েমেনের বিদ্রোহী সংগঠন হুতিরা মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের অস্বস্তিতে ফেলে আসছিল। তারা এতটাই পারদর্শিতা দেখাচ্ছিল যে, তাদের অনেক যুদ্ধ পরিকল্পনা নকল করতে শুরু করে পেন্টাগন। হুতিরা এমন এক ধরনের রাডার ব্যবহার করছে, যা সহজলভ্য।
যুক্তরাষ্ট্রের এক জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তা মার্কিন নৌ সেনাদেরও এমন ধরনের রাডার সংগ্রহের পরামর্শ দিয়েছিলেন। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে বাল্টিক সাগরে মার্কিন নৌবাহিনী হুতিদের মতো রাডার সিস্টেম চালুর উদ্যোগ নেয়। কারণ, পেন্টাগন কর্মকর্তারা জানতেন, হুতিরা হামলা শুরু করলে ঠেকানো তাদের পক্ষে সহজ কাজ হবে না।
বুধবার নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। বাইডেন প্রশাসন ইয়েমেনে হুতিদের ওপর তৃতীয় সপ্তাহের মতো হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। কার্যত লোহিত সাগরে বাণিজ্যিক জাহাজগুলোতে হামলা চালানোয় হুতিদের যে সক্ষমতা রয়েছে, তা কমাতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। তবে এটা যে সহজ কাজ নয়, তা স্বীকার করছে মার্কিন সামরিক বাহিনী। কারণ, হুতিরা অনিয়মিত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ায় পারদর্শিতা অর্জন করেছে। মার্কিন যুদ্ধবিমানকে আঘাত করার জন্য হুতিদের বড় অস্ত্র নেই। তবে তারা পিকআপ ট্রাকে করে ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে সক্ষম। এতে তাদের টার্গেটে পরিণত করা কঠিন।
পেন্টাগন জানিয়েছে, দুই সপ্তাহ আগে প্রথম ইয়েমেনের ৩০টি স্থানে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন বিমান হামলা হয়। এগুলো যেসব স্থানে আঘাত হেনেছে, তার ৯০ শতাংশই ধ্বংস হয়েছে। এত বড় সাফল্যের পরও লোহিত সাগরে হুতিদের ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন নিক্ষেপের ৭৫ শতাংশ সক্ষমতা অটুট আছে। পরে আরও সাত দফা হামলা চালায় পেন্টাগন। পাশাপাশি হুতিরাও লোহিত সাগরে জাহাজে হামলা অব্যাহত রেখেছে।
২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত মার্কিন সামরিক বাহিনীর সেন্ট্রাল কমান্ডের প্রধান জেনারেল জোসেফ এল ভোটেল বলেন, ‘এটা উপেক্ষা করার কিছু নেই যে, বিষয়টিকে কেন্দ্র করে জটিলতা রয়েছে। এখন পেন্টাগনের পরিকল্পনা এই যে, তারা সশস্ত্র ও পর্যবেক্ষক ড্রোন দিয়ে ইয়েমেনের আকাশে নজরদারি বাড়াবেন। এর লক্ষ্য মার্কিন রণতরী ও জাহাজ থেকে হুতিদের ভ্রাম্যমাণ লক্ষ্যে হামলা চালানো।’
গত সোমবার রাতে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন ইয়েমেনে ৯টি স্থানে হামলা চালায়; একেক স্থানে একাধিক হামলাও হয়েছে। এসব হামলা আগের মতো ছিল না। আগে সুযোগ বুঝে হামলা চালানো হলেও এবার সুপরিকল্পিতভাবে নৈশকালীন হামলা হয়েছে। রাডার, ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের স্থানগুলোতে এসব হামলা চালানা হয়। লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে হুতিদের ভূগর্ভস্থ অস্ত্রাগার ও বাঙ্কার। এসব হামলা হুতিদের সামর্থ্যকে কমালেও ওই অঞ্চলে আরও বেশি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন, তারা হুতিদের বিরুদ্ধে হামলা অব্যাহত রাখবেন।
এক দশক ধরে মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক শক্তি প্রতিবেশী সৌদি আরবের সঙ্গে লড়াই করেছে হুতিরা। সৌদি বিমান হামলার মধ্য দিয়ে তারা আত্মরক্ষার কৌশল শিখেছে। কীভাবে অস্ত্রশস্ত্র শহরাঞ্চলে রেখে গাড়ি অথবা ট্রাক্টরের পেছন থেকে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করতে হয়, সেটা রপ্ত করেছে। মার্কিন কর্মকর্তারা বলেন, যেসব অস্ত্র ধ্বংস করা হয়েছে, শিগগির তার প্রতিস্থাপন করে দেবে ইরান। ১১ জানুয়ারির অভিযান পরিচালনার পরও মূল্য দিতে হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রকে। রোববার পেন্টাগন জানায়, ছোট নৌকা দিয়ে একটি অভিযান পরিচালনাকালে মার্কিন নেভি সিলের যে দুই সদস্য নিখোঁজ হয়েছিলেন, ১০ দিন অনুসন্ধানের পরও তাদের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। পরে তাদের মৃত ঘোষণা করা হয়েছে।
ধারণা করা হচ্ছে, ২০১৪ সালে ইয়েমেনে গৃহযুদ্ধ শুরুরও আগে হুতিরা ভূগর্ভস্থ সম্মেলনস্থল ও অস্ত্র তৈরির কারখানা বানিয়েছিল। লন্ডনে ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের মধ্যপ্রাচ্য, ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন বিশেষজ্ঞ ফোবিয়ান হিঞ্জ বলেন, হুতিদের অস্ত্রাগারের বৈচিত্র্য আসলেই বিস্ময়কর। ইরান সমর্থিত লেবাননের সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহ তাদের সহায়তা করে থাকে। হুতিদের শীর্ষ কমান্ডাররা লেবাননে হিজবুল্লাহর কাছে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।
ইরাকে হামলা
বিবিসি জানায়, ইরাকে ইরান সমর্থিত আধা সামরিক গোষ্ঠীর ওপর হামলা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। গতকাল বুধবার ইরাকের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মেদ শিয়া আল-সুদানি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য স্পষ্টভাবে দেশটির সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করেছে। ইরাকের আধা সামরিক গোষ্ঠী পপুলার মোবালাইজেশন ফোর্সেস (পিএমএফ) বলছে, ‘প্রতারক’ যুক্তরাষ্ট্রের হামলার কারণে তাদের এক সদস্য নিহত হয়েছেন। ইরাকের মধ্যাঞ্চলীয় প্রদেশ বাবিলের জুরফ আল-নাসর ও পশ্চিমাঞ্চলীয় আনবার প্রদেশের সিরিয়া সীমান্তবর্তী আল-কায়েম শহরে এসব হামলা হয়। মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন জানান, সশস্ত্র সংগঠন কাতাইব হিজবুল্লাহ ও অন্য সশস্ত্র সংগঠনগুলোকে লক্ষ্য করে তিনটি স্থাপনায় হামলা হয়েছে।