ফেব্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে এমনটা ধরেই মাঠে নেমেছে বিএনপি। নির্বাচনি নানা কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি ঘর গোছাতেও ব্যস্ত সময় পার করছেন দলটির নেতারা। ভোটের তফশিল ঘোষণার আগেই তৃণমূলের যেসব কমিটি ইতোমধ্যেই মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে, সেখানে নতুন কমিটি দেওয়ার বিষয়ে মৌখিক নির্দেশনা দেওয়া হয়। ঢাকা ছাড়া ৯ সাংগঠনিক বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা এ নিয়ে মাঠে কাজ করছেন। দলটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গণতান্ত্রিক উপায়ে কাউন্সিলের মাধ্যমে সারা দেশের ইউনিয়ন, পৌর, থানা, উপজেলা, মহানগর ও জেলা কমিটি করা হবে। তবে কমিটি গঠন নিয়ে অন্তর্বিরোধও নতুন করে সামনে আসছে। কয়েকটি উপজেলা কমিটি গঠন নিয়ে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। আবার কমিটি দিয়ে নানা বিতর্কের মুখে সেই কমিটি বাতিলের ঘটনা আছে। বিএনপি সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
এদিকে বিগত আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় ছিলেন, নির্যাতিত, ক্লিন ইমেজ ও দলের প্রতি আনুগত্য-এমন নেতাকর্মীদের কমিটিতে যথাযথ মূল্যায়ন করার বিষয়ে বিএনপির হাইকমান্ডের নির্দেশনা রয়েছে। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেশ কয়েকটি উপজেলা কমিটি গঠনে হাইকমান্ডের নির্দেশনা মানা হয়নি। কাউন্সিল না করেও কমিটি দেওয়া হয়েছে। আবার আওয়ামী লীগের বিগত সাড়ে ১৫ বছরে যাদের দলের কর্মকাণ্ডে সক্রিয় দেখা যায়নি, হামলা-মামলার শিকার হননি, তারাও কোনো কোনো কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ পদ পাচ্ছেন। এ নিয়ে দুর্দিনে মাঠে থাকা নেতাকর্মীদের অনেকে হতাশাও প্রকাশ করেছেন। বিষয়টি তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও তুলে ধরেছেন।
উত্তরাঞ্চলের একটি বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা বিএনপির এক নেতা যুগান্তরকে বলেন, ‘কমিটি গঠনে কাজ করে যাচ্ছি। সেপ্টেম্বরের আগেই কমিটি গঠনের কাজ শেষ করার নির্দেশনা রয়েছে। বিএনপি বড় দল। দলে অনেক নেতা আছেন, আবার সবাই দলের নেতৃত্ব দিতে চান। কিন্তু সবাই তো আহ্বায়ক-সদস্য সচিব হবেন না। কেউ বাদ পড়ে গেলেই তাদের অনুসারীরা বিক্ষোভ করতে দেখা যাচ্ছে। যদিও পরে আবার তা সমাধানও করা হচ্ছে। কমিটিতে ত্যাগীদের মূল্যায়নের বিষয়টি সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরে বিএনপি কোথাও সম্মেলন করতে পারেনি, কেন্দ্র থেকে কমিটি দেওয়া হয়েছে। এবার ওয়ার্ড থেকে জেলা পর্যন্ত নির্বাচনের মাধ্যমে কমিটি গঠনের চেষ্টা করছেন।’
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী যুগান্তরকে বলেন, ‘কমিটি গঠনে বিভাগীয় পর্যায়ে যারা তত্ত্বাবধায়ন করছেন, তারা কাজ করছেন। তৃণমূলে গিয়ে বৈঠক করছেন। কমিটি গঠন একটি চলমান প্রক্রিয়া।’
২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত প্রতিকূল পরিবেশে রাজনীতি করেছে বিএনপি। অভ্যুত্থানের পর দলকে আরও শক্তিশালী করতে পুরোপুরি সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে ফিরে দলটি। গত বছরের নভেম্বরে ঢাকা বাদে ৯ সাংগঠনিক বিভাগের অন্তর্ভুক্ত ইউনিয়ন, উপজেলা, পৌর, থানা কমিটি থেকে শুরু করে মহানগর ও জেলা কমিটি সম্মেলন ও কাউন্সিলের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ কমিটি শেষ করতে ৯ সিনিয়র নেতাকে চিঠি দিয়ে দায়িত্ব দেওয়া হয়। ৩ মাসের মধ্যে এসব কমিটি শেষ করারও নির্দেশনা ছিল ওই চিঠিতে।
রাজশাহী বিভাগের দায়িত্ব দেওয়া হয় চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আব্দুস সালামকে, সিলেট বিভাগে স্থায়ী কমিটির সদস্য অধ্যাপক এজেডএম জাহিদ হোসেন, ময়মনসিংহ বিভাগে যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেল, খুলনা বিভাগে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমানউল্লাহ আমান, বরিশাল বিভাগে ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল আউয়াল মিন্টু, রংপুর বিভাগে ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু, কুমিল্লা বিভাগে ভাইস চেয়ারম্যান বরকতউল্লা বুলু, ফরিদপুর বিভাগে ভাইস চেয়ারম্যান ড. আসাদুজ্জামান রিপন ও চট্টগ্রাম বিভাগে ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আহমেদ আযম খানকে। দায়িত্বপ্রাপ্তরা বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক, সহসাংগঠনিক সম্পাদকদ্বয় এবং মহানগর ও জেলার সভাপতি/আহ্বায়ক, সাধারণ সম্পাদক/সদস্য সচিবদের সঙ্গে বৈঠক করে সম্মেলনের কার্যক্রম শুরু করারও নির্দেশনা ছিল। তবে দায়িত্ব পাওয়ার পর নেতারা এরই মধ্যে ৭ মাস পার করেছেন।
ফরিদপুর বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত ভাইস চেয়ারম্যান ড. আসাদুজ্জামান রিপন যুগান্তর বলেন, ‘জেলা থেকে তৃণমূল পর্যন্ত গণতান্ত্রিক উপায়ে কাউন্সিলের মাধ্যমে কমিটিগুলো হচ্ছে। ৫ আগস্টের আগে সাড়ে ১৫ বছর ধরে আমরা সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড করতে পারিনি। ঘরে বসে করতে হয়েছে, প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে করতে হয়েছে। তখন এক অন্য ধরনের বাস্তবতা ছিল। এখন আমরা কর্মীদের অংশগ্রহণের মাধ্যমেই কমিটি করছি। সংগঠনকে প্রাণবন্ত রাখতে হলে একটা গণতান্ত্রিক ধারায় কর্মীদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে এবং তাদের আকাক্সক্ষা ও ইচ্ছার প্রতিফলন থাকতে হবে কমিটিতে। তাদের ভোটে কমিটি হতে হবে। এটিই হচ্ছে আমাদের স্পিরিট। সে অনুযায়ী কাজ হচ্ছে।’
বিএনপির চট্টগ্রাম বিভাগীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক ব্যারিস্টার মীর মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, চট্টগ্রাম দক্ষিণ, বান্দরবান ও নোয়াখালী জেলার নতুন কমিটি দেওয়া হয়েছে। তারা আবার তাদের অধীনে থাকা সব কমিটি ভেঙে দিয়ে নতুন করে শুরু করছে। বিভাগে বাকি যেগুলো আছে অন্তত ৮০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। সব কমিটি গঠনের কাজ সেপ্টেম্বরের মধ্যে শেষ হবে। সূত্রমতে, বিএনপির ৮২ সাংগঠনিক জেলার বেশিরভাগই আহ্বায়ক কমিটি। এছাড়া তৃণমূল পর্যায়ের অনেক জায়গায় আহ্বায়ক কমিটি আছে, অনেক জায়গায় কমিটিই নেই।
বেশির ভাগই মেয়াদোত্তীর্ণ। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নভেম্বরের পর থেকে মেহেরপুর, কুড়িগ্রাম, মাগুরা, নাটোর, বান্দরবান, চট্টগ্রাম দক্ষিণ, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, নোয়াখালী, সাতক্ষীরা, কুমিল্লা দক্ষিণ, কুমিল্লা মহানগর, নরসিংদী, খুলনা, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ আরও কয়েকটি জেলার নতুন কমিটি দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে নরসিংদীর কমিটি হয়েছে সরাসরি ভোটের মাধ্যমে। তৃণমূলের ইউনিয়ন, ওয়ার্ড, উপজেলা, পৌর, থানারও অনেক কমিটি দেওয়া হয়েছে। বাকি কমিটি গঠনে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা কাজ করছেন।
এদিকে জেলার নতুন কমিটি নিয়ে তেমন কোনো অভিযোগ না থাকলেও তৃণমূলের বেশ কয়েকটি কমিটি নিয়ে নানা অভিযোগ পাওয়া গেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সম্প্রতি গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলায় ও পৌর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে বিএনপির দুই পক্ষের ধাওয়া-পালটাধাওয়া, ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। অনুমোদনের পর আলোচনা ও সমালোচনার মুখে ৯ দিনের মাথায় বাতিল করা হয় পাবনার ফরিদপুর উপজেলার বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি। ত্যাগী নেতাদের বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আঁতাত করে চলা বিতর্কিত নেতাদের পদ দেওয়ায় সেখানকার নেতাকর্মীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এ বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে লিখিত অভিযোগও দিয়েছিলেন পাবনার ফরিদপুর উপজেলার স্থানীয় নেতারা। মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার ইশিবপুর ইউনিয়ন বিএনপির দ্বিবার্ষিক সম্মেলনেও দুপক্ষের মধ্যে হট্টগোলের ঘটনা ঘটে।