নিজেকে সবসময় ‘ভাগ্যবান মানুষ’ হিসেবেই জানান দিতেন সদ্য সাবেক স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় (এলজিআরডি) মন্ত্রী মো.তাজুল ইসলাম। কারণ, ব্যবসায়ী তাজুল রাজনীতিতে আসার কয়েক মাসের মধ্যেই ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো কুমিল্লা-৯ (লাকসাম-মনোহরগঞ্জ) আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালের পর যতগুলো জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে, তার প্রতিটিতেই এ আসনে নৌকার প্রার্থী ছিলেন তিনি। ২০০১ সালের নির্বাচনে পরাজিত হলেও ২০০৮ সাল থেকে টানা চার মেয়াদে কুমিল্লা-৯ আসনের এমপি নির্বাচিত হয়েছেন তাজুল।
লাকসামের আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভোকেট ইউনুস ভূঁইয়ার হাত ধরে রাজনীতিতে আসা তাজুল প্রথমবার এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই নিজের ভোল পাল্টাতে শুরু করেন। সেই সময় থেকেই নিজেকে ‘স্যার’ ডাকতে বাধ্য করেন দলের নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষকে। একটা পর্যায়ে এসে তাকে ‘স্যার’ বলে সম্মোধন না করলে ‘মাইন্ড’ করতেন তিনি। যদিও তাজুলের আগে ওই আসনে কোনো রাজনীতিবিদকে ‘স্যার’ বলে সম্মোধনের প্রচল দেখা যায়নি।
এমপির পদে বসেই আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাদের কোণঠাসা করে তাজুল বিস্তার করতে থাকেন নিজের সাম্রাজ্য। গড়ে তোলেন নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনী।
২০০৮ সালে দ্বিতীয়বারের মতো এমপি নির্বাচিত হয়ে আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তাজুল। নিজেকে ভাবতে শুরু করেন লাকসাম ও মনোহরগঞ্জ উপজেলার একক অধিপতি।
রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দলগুলোর পাশাপাশি আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাদের কোণঠাসা করে দাবিয়ে রাখার হোলিখেলায় মেতে ওঠেন তিনি। দিন যত গেছে তাজুলের নিজ আত্মীয়-স্বজন ও পছন্দের হাইব্রিড নেতাদের দিয়ে দল পরিচালনার পরিধি ততই বেড়েছে। ২০১৮ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর এলজিআরডি মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পান তাজুল। তখনই অহংকার ও দম্ভের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছান তিনি। মন্ত্রিত্ব পেয়েই আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
নিজ নির্বাচনী এলাকার সাধারণ মানুষ তো বটেই, দলের নেতাকর্মীদেরও আর প্রয়োজন বলে মনে করেননি। লাকসাম-মনোহরগঞ্জের সম্রাট যেন তিনিই।
মন্ত্রিত্ব পাওয়ার পর তাজুল লুটপাট আর অবৈধ সম্পদ অর্জনের খেলায় মেতে ওঠেন। দেশে ও বিদেশে এরই মধ্যে বিপুল পরিমাণ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন বলে জানা গেছে। তাজুলের সম্পদ কী পরিমাণে বেড়েছে তা ২০১৪, ২০১৮ এবং গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হলফনামা বিশ্লেষণেই কিছুটা আন্দাজ হয়। ১০ বছর আগে ২০১৪ সালের নির্বাচনে হলফনামায় দেওয়া তথ্যে তার মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল ১৬ কোটি টাকার কিছু বেশি। আর গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে দেওয়া হলফনামার বিশস্নেষণ করলে দেখা যায়, তাজুলের সেই সম্পদ ১১৮ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। আর মন্ত্রী হওয়ার আগে ২০১৮ সালে তার মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল ৪৭ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। চার বছরের ব্যবধানে সেই সম্পদ দ্বিগুণের বেশি হয়েছে। তাজুল কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতির পদে রয়েছেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদের বিতর্কিত নির্বাচনে বিজয়ী হলে দ্বিতীয় মেয়াদে একই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রিত্ব পান।
গত সোমবার (৫ আগস্ট) ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর দেশত্যাগ এবং দেশবাসীর উদ্দেশে সেনাপ্রধানের দেওয়া বক্তব্য শুনেই সারাদেশের মতো লাকসাম ও মনোহরগঞ্জ উপজেলায়ও মুক্তিকামী ছাত্র-জনতা রাস্তায় নেমে আসেন। একই সঙ্গে অবসান ঘটে তাজুলের অহংকার ও দম্ভেরও। হাসিনার বিদায়ের পরপরই বিক্ষুব্ধ জনতা মনোহরগঞ্জের পোমগাঁও গ্রামে অবস্থিত তাজুলের আলিশান বাড়িতে ব্যাপক ভাঙচুর চালায়। এরপর অগ্নিসংযোগ করা হয় পুরো বাড়িতে। লুটপাট করে নেওয়া হয় বাড়ির সকল মালামাল। একই সময়ে ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে লাকসামের পাইকপাড়ায় অবস্থিত তাজুলের আরেকটি বাড়িতেও। এ সময় বিক্ষুব্ধ জনতাসহ সাধারণ মানুষ বলতে থাকেন, দীর্ঘ দেড় যুগ পর জালিমের হাত থেকে মুক্ত হয়েছে লাকসাম ও মনোহরগঞ্জ উপজেলা। এতদিন নিজেকে লাকসাম ও মনোহরগঞ্জের প্রভু ভাবতেন তাজুল। তাজুলের বিদায়ে দুই উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলেও সাধারণ মানুষকে মিষ্টি বিলাতে দেখা গেছে।
এদিকে, হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও প্রকাশ্যে সাধারণ মানুষ তাজুলকে নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করছেন। মুখ খুলতে শুরু করেছেন তাজুলের দীর্ঘদিনের দুঃশাসন নিয়ে। সাধারণ মানুষ ফেসবুক পোস্টে লিখছেন, এক অহংকারী শাসকের হাত থেকে লাকসাম ও মনোহরগঞ্জ মুক্ত হয়েছে। আবার কেউ লিখছেন, এখন থেকে লাকসাম ও মনোহরগঞ্জে কোনো ‘স্যার’ নেই। আমরা সামনে কোনো ‘স্যার’ নয়, একজন সেবক চাই।
দেশের স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে কিভাবে বিনা ভোটে বিজয়ী হওয়া যায় সেই পদ্ধতির প্রবর্তক বলা হয় তাজুল ইসলামকে। কারণ তিনিই লাকসাম ও মনোহরগঞ্জে প্রথমবারের মতো বিনা ভোটে বিজয়ী হওয়ার কৌশল রপ্ত করেন। বিগত সময়ে দুই উপজেলা পরিষদ থেকে প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মেম্বার পর্যন্ত সবাইকে বিনাভোটে জনপ্রতিনিধি বানাতে দেখা গেছে তাজুলকে। লাকসাম পৌরসভার মেয়র থেকে শুরু করে প্রতিটি কাউন্সিলরকেও বিনা ভোটে জনপ্রতিনিধি বানাতে দেখা গেছে তাকে। লাকসামে শ্যালক ও মনোহরগঞ্জে ভাতিজাকে পরপর দুইবার বানিয়েছেন উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান। এ ছাড়া নিজের আত্মীয়-স্বজনদের দিয়েছেন দলীয়সহ জনপ্রতিনিধির শীর্ষ পদ। তাজুলের ভয়ে দলমত নির্বিশেষে সবাই ছিলেন তটস্থ। কেউ তার বিরোধিতা করলেই তুলে নিয়ে চালাতো হতো নির্যাতন; একের পর এক মিথ্যা ও গায়েবি মামলা দিয়ে করা হতো হয়রানি।
লাকসামের বাসিন্দা ফারুক হোসেন বলেন, তিনি (তাজুল) দম্ভ করে বিভিন্ন জনসভায় বলতেন, আমাকে সম্মান করে কেউ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রার্থী হয় না। সবাই আমার সিদ্ধান্তকে সম্মান করে। তাই সবাই বিনা ভোটে জেতে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন- তার ভয়ে কেউ প্রার্থী হওয়ার সাহস করতো না। সামনে গেলে কাউকে বসতেও দিতেন না; সবাইকে সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো।
মোস্তাফিজুর রহমান নামে একজন বলেন, তাজুল ইসলাম কত হাজার কোটি টাকার মালিক সেটা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেন না। নির্বাচনী হলফনামায় দেওয়া তথ্য তার সম্পদের সিকিভাগও না। তিনি দেশের বিভিন্ন স্থানে ও বিদেশে প্রচুর পরিমাণে অবৈধ সম্পদ গড়েছেন। দুদক ভালোভাবে তদন্ত করলেই সব বেরিয়ে আসবে।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতা হিসেবে পরিচিত এক ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তাজুল ইসলাম লাকসাম ও মনোহরগঞ্জে বঙ্গবন্ধুর নয়, নিজের আদর্শের আওয়ামী লীগ দিয়ে দল চালিয়েছেন। সবসময় দম্ভের সঙ্গে বলতেন, লাকসাম ও মনোহরগঞ্জে আমি তাজুল ইসলামই শেষ কথা। তিনি আত্মীয় লীগ, হাইব্রিড এবং সন্ত্রাসের ওপর নির্ভর করে রাজনীতি করতেন।
মনোহরগঞ্জের এক বিএনপিকর্মী বলেন, দশ বছর পর বাড়িতে ঘুমিয়েছি। ২০১৪ সালের পর আমাদের কাউকে একদিনের জন্যও শান্তিতে থাকতে দেয়নি তাজুল ইসলাম। বাড়ি বাড়ি হামলা ও লুটপাট করেছে তার লোকেরা। মিথ্যা ও গায়েবি মামলা দিয়ে আমাদের ওপর জেল, জুলুম ও অত্যাচার করেছে। সারাদেশে বিএনপির রাজনীতি কিছুটা করা গেলেও তার অত্যাচার ও সন্ত্রাসের কারণে আমরা ন্যুনতম সাংগঠনিক কাজ করতে পারিনি। অথচ লাকসাম ও মনোহরগঞ্জ উপজেলাকে বিএনপির ঘাঁটি বলা হয়।
এসব প্রসঙ্গে জানতে মোবাইল ফোন, হোয়াটসঅ্যাপসহ বিভিন্ন মাধ্যমে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও সদ্য সাবেক স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় (এলজিআরডি) মন্ত্রী মো.তাজুল ইসলামের বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।