সিরিয়ার দামেস্কে ইরানি কনস্যুলেটে ইসরায়েলি হামলায় চরম ক্ষিপ্ত তেহরান। পাল্টা প্রতিশোধে ইসরায়েলে শতাধিক ড্রোন ও মিসাইল ছুড়ে হামলা চালিয়েছে ইরান।
কিন্তু ইরানের হামলায় তেমন কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি ইসরায়েলের। কেননা, তেল আবিবের প্রতিরক্ষায় ঢাল হয়ে পাশে ছিল যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের মত মিত্র দেশগুলো এবং কিছু আরব দেশও।
ইরানের সেই ড্রোন হামলাকে নস্যাৎ করার জন্য সৌদি আরবের পাশাপাশি ছিল প্রতিবেশী দেশ জর্ডানও। আরব দেশ হয়েও ইসরায়েলের সহযোগী শক্তি হিসাবে জর্ডানের এমন অবস্থান ছিল রীতিমতো অবাক করার মতো।
আল জাজিরা জানায়, ইরানের ছোড়া তিন শতাধিক ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোনের অনেকগুলো ইসরায়েলের আকাশসীমায় প্রবেশ করার আগেই ধ্বংস করে জর্ডান।
ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধের শুরু থেকেই ফিলিস্তিনের পাশে থাকা এবং গাজায় ইসরায়েলের হত্যাযজ্ঞের কঠোর নিন্দা ও সমালোচনা করে আসছে জর্ডান। তাই ইরানি আক্রমণ ঠেকিয়ে ইসরায়েলকে রক্ষা করতে জর্ডানের ভূমিকা এখন সবার কাছে প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ফিলিস্তিনিপন্থী সোচ্চার আরব নেতাদের মধ্যে অন্যতম জর্ডানের বাদশাহ দ্বিতীয় আবদুল্লাহ। কিন্তু রোববার তার আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও যুদ্ধবিমান ইসরায়েলের পক্ষে লড়াই করায় অবাক অনেক দেশ।
জর্ডানের আর্থিক ও ভৌগলিক অবস্থান
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, জর্ডান ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকলেও বাস্তবে সামরিকভাবে দেশটি দুর্বল। এছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের মতো অশান্ত অঞ্চলে জর্ডান অপেক্ষাকৃত দরিদ্র দেশও। এমনকি আর্থিকভাবে সাহায্যের জন্যও জর্ডানকে অন্য দেশের দারস্থ হতে হয়।
ফলে জর্ডানকে প্রতিবেশি, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক খেলোয়াড়দের সঙ্গে একটি সূক্ষ্ম ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক বজায় রাখতে হয়। বিশেষ করে শক্তিশালী প্রতিবেশির সঙ্গে যুদ্ধের কোনো ঝুঁকি নিতে পারে না জর্ডান।
অন্যদিকে ইসরায়েলের সঙ্গে সীমান্ত ভাগাভাগি করে জর্ডান। ফলে ইসরায়েলের সঙ্গে যে কোনো বৈরী সম্পর্ক অর্থনৈতিকভাবে দেশটিকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। আবার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও মিত্রতার সম্পর্ক জর্ডানের। ফলে নিজেদের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং আত্মরক্ষার স্বার্থেই ইরানের হামলায় ইসরায়েলের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে দেশটি।
এছাড়াও ইসরায়েলকে রক্ষার পেছনে জর্ডানের কূটনৈতিক বিষয় ছাড়াও পেছনে রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাসও। এর মধ্যে রয়েছে ইসরায়েল-জর্ডান শান্তি চুক্তি। ওয়াদ্দি আরাবা নামে সেই চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয় ১৯৯৪ সালে ২৬ অক্টোবর। এই চুক্তিটি দুই দেশের মধ্যে ভূমি, পানি, ব্যবসা এবং ভ্রমণের ক্ষেত্রে সম্পর্ক স্থাপিত করে। এই চুক্তিটির আরও একটি অঙ্গীকার ছিল কোনো দেশই তাদের ভূমি ব্যবহার করে তৃতীয় কোনো দেশকে আক্রমণ করতে দেবে না।
জর্ডান-ইসরায়েল সম্পর্ক
১৯৪৮ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় জর্ডান অন্যান্য আরব দেশের সঙ্গে মিলে ফিলিস্তিন আক্রমণ করে। যুদ্ধের পর পশ্চিম তীর ও ফিলিস্তিনের পূর্বাঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নেয় জর্ডান। ১৯৫০ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে অঞ্চলগুলোকে নিজের ভূসীমার সঙ্গে সংযুক্ত করে নেয় জর্ডান। দেশটির এমন পদক্ষেপের তীব্র সমালোচনা করে আন্তর্জাতিক মহল।
প্রায় ২০ বছর পর ফের মুখোমুখি হয় জর্ডান ও ইসরায়েল। সেবার জর্ডান পরাজিত হয়। ফলে পশ্চিম তীর ও জেরুজালেম হাতছাড়া হয়ে যায়। অবশেষে ১৯৯৪ সালে ইসরায়েলের সঙ্গে একটি শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করে জর্ডান।
শান্তি চুক্তি অনুযায়ী জর্ডান ও ইসরায়েল তাদের সীমান্ত খুলে দেয়। এর পর থেকে আজ অবধি দুই দেশের যৌথ ৩০৯ কিলোমিটারের সীমানা ওই অঞ্চলে সবচেয়ে শান্ত একটি সীমানা। এরপর থেকে দুইদেশে স্থায়ী দূতাবাস স্থাপন, ভ্রমণ ভিসা,মুক্ত বাণিজ্য নিয়ে চুক্তি হয়।
জর্ডানের বক্তব্য
এদিকে শনিবার ইরানের হামলার পর রোববার নিজেদের অবস্থান নিয়ে বক্তব্য দিয়েছে জর্ডান সরকার।
সেই বিবৃতিতে বলা হয়, জর্ডানের এই সামরিক পদক্ষেপ শুধুমাত্র নিজেদের আত্মরক্ষার জন্য, ইসরায়েলের রক্ষা বা সুবিধার জন্য নয়। জর্ডান সরকার আরও জানিয়েছে, তাদের সামরিক বাহিনী নিজ দেশের নাগরিক, আকাশসীমা এবং ভূখণ্ডের প্রতিরক্ষায় যে কোনো পক্ষের ভবিষ্যতের আক্রমণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে।
তবে এই জর্ডানের এই পদক্ষেপের কারণে জর্ডানের বাদশাহ আবদুল্লাহ আরব বিশ্বে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইসরায়েলি সামরিক ইউনিফর্মে বাদশাহর একটি মিম ভাইরাল হয়েছে। এমনকি জর্ডানের এই পদক্ষেপের কারণে ক্ষুব্ধ স্থানীয় নাগরিকরাও।