বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে স্থায়ী মুক্তি না দেওয়া এবং বিদেশে যেতে না দেওয়ার বিষয়ে আওয়ামী লীগ সরকার অনড়। ফলে এবারও পরিবারের আবেদনে সাড়া দেয়নি আইন মন্ত্রণালয়। আওয়ামী লীগ ও সরকারের একাধিক নীতিনির্ধারকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খালেদা জিয়ার বিদেশ নেওয়ার ইস্যুতে সরকার তার অবস্থান থেকে সরবে না।
এ নেতারা বলছেন, খালেদা জিয়া বিদেশে যেতে পারলে বিএনপি আবার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করবে। সে সুযোগ দলটিকে দেওয়া যাবে না। তাহলে বিএনপিকে সামলানো কঠিন হয়ে যাবে।
গত ৬ মার্চ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে খালেদা জিয়ার পরিবারের পক্ষ থেকে করা আবেদনের বিষয়ে গতকাল বুধবার মতামত দিয়ে সেটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘একজন দ-প্রাপ্ত আসামির ব্যাপারে সর্বোচ্চ সহানুভূতিশীল সরকার।’
তিনি আরও বলেন, ‘খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত করা হয়েছে। উন্নত চিকিৎসার সুযোগও দেওয়া হচ্ছে। আইনের বাইরে গিয়ে বিদেশ যাওয়ার সুযোগ সরকার দিতে পারে না। ফৌজদারি কার্যবিধি-৪০১ ধারার বাইরে গিয়ে সরকারের কিছু করার নেই।’
আইনমন্ত্রীর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিতের মেয়াদ আট দফা বাড়ানো হয়েছে।
এ ছাড়া অসুস্থ খালেদা জিয়াকে দেশে উন্নত ও আধুনিক চিকিৎসাসেবার সুযোগও দিচ্ছে। তার চিকিৎসার জন্য বিদেশ থেকেও চিকিৎসক আনার অনুমতি দিয়েছে সরকার।
সরকারি দল ও সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খালেদা জিয়াকে বিদেশ নেওয়ার ইস্যুতে সরকারের যে নীতি অবলম্বন করেছে তা থেকে কোনোভাবেই টলানো যাবে না। খালেদা জিয়াকে বিদেশ নেওয়ার ব্যাপারে এর আগে বিদেশি নানা উদ্যোগও দেখা যায়। কিন্তু কোনোভাবেই তা আমলে নেয়নি শেখ হাসিনার সরকার।
আওয়ামী লীগ ও সরকারের অন্তত দশজন নীতিনির্ধারকের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তারা বলেন, খালেদা জিয়ার শারীরিক পরিস্থিতি যত জটিলই হোক, বিদেশে চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ কোনোভাবেই দেওয়া হবে না তাকে। বিএনপি নেতারা দলের চেয়ারপারসনকে বিদেশ নেওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টার পেছনের কারণ দলটি ঘুরে দাঁড়ানোর কৌশল গ্রহণ করেছে। ক্ষমতাসীন দলের এ নেতারা বলেন, সেই ফাঁদে কেন পা দেবে সরকার? খালেদা জিয়াকে এ সুযোগ দেওয়া হলে বিএনপি যে জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে, তাতে বেকায়দায় পড়তে হবে সরকারকে।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা মনে করেন, বিএনপি চেয়ারপারসন বিদেশ যেতে পারলেই সাবেক আমলা, সাবেক সেনা কর্মকর্তা, সাবেক বিচারপতি, বিএনপির সময়ে সুবিধাভোগকারী বিভিন্ন পেশায় যারা আছেন তারা খালেদা জিয়া ঘিরে চাঙ্গা হয়ে উঠবেন। বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজ সবাই খালেদার সঙ্গে কারণে, অকারণে দেখা করতে, শলা-পরামর্শ করতে বিদেশমুখী হবেন।
তারা বলেন, দেশে থাকলে খালেদা জিয়াকে আইনের আওতায় থাকতে হবে। ফলে রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার সুযোগ নেই। তাই বিদেশ থেকে চিকিৎসক আনার সুবিধাসহ চিকিৎসায় সবরকম সহায়তা দিতে ইচ্ছুক সরকার। কিন্তু কোনোভাবেই তাকে বিদেশ যেতে দেবে না সরকার।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য বলেন, দেশের বাইরে চলে গেলে আইন মেনে চলার ব্যাপারে কোনো বাধ্যবাধকতা থাকবে না খালেদা জিয়ার। ফলে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়ানোর সুযোগ সৃষ্টি হবে খালেদার। দেশ-বিদেশের সম্পর্কগুলো তাকে ঘিরে শক্ত ও সক্রিয় হয়ে উঠবে।
তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে তথ্য রয়েছে, বিএনপি খালেদা জিয়াকে দেশের বাইরে নিয়ে রাজনীতিতে টিকে থাকার শেষ চেষ্টা করছে। বিশেষ করে বিদেশি সম্পর্কগুলো খালেদা জিয়াকে সামনে রেখে শক্তিশালী করে তুলতে চায় বিএনপি।’
২০০৮ সাল থেকে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি আন্দোলন করে সরকার হটাতে ব্যর্থ হয়েছে। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় দুই দফা সংসদ নির্বাচন বর্জন করেও রাজনীতিতে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। ২০১৮ সালে খালেদা জিয়ার দুর্নীতির দুটি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কারাগারে গেলে বিএনপির নেতৃত্ব আগের চেয়ে দুর্বল হয়ে পড়ে। কারণ দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও কয়েকটি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত এবং তিনি দীর্ঘদিন ধরে লন্ডনে বসবাস করছেন।
আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য বলেন, বিএনপি নেতা তারেক রহমানের ব্যাপারে দলটির নেতাদের মধ্যে যে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ঘাটতি দেখা দিয়েছে, সেই ঘাটতি খালেদা জিয়াকে দেশের বাইরে নিয়ে যেতে পারলে পূরণ করতে পারবে দলটি, এমনটিই মনে করছেন তারা। এ ছাড়া তারা মনে করেন, তারেক রহমানের প্রতি প্রভাবশালী দেশগুলোর যে অবিশ্বাস সৃষ্টি করে হয়েছে, সেটা খালেদা জিয়াকে দিয়ে সারিয়ে তুলতে চায় বিএনপি। তাই খালেদার চিকিৎসার চেয়েও ঘুরে দাঁড়ানোর প্রয়োজনে তাকে বিদেশ নিতে মরিয়া দলটি।
দলের সম্পাদকমণ্ডলীর ওই নেতা আরও বলেন, খালেদা জিয়া দুবারের প্রধানমন্ত্রী থাকার কারণে অনেক দেশের নীতিনির্ধারণী মহলে তার গ্রহণযোগ্যতা ছিল। খালেদা কারাবন্দি ও শাস্তির আওতায় থাকায় তার সেসব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ফলে তার পুরনো সেই যোগাযোগ বিএনপি বা তারেক রহমান কাজে লাগাতে পারছে না। খালেদা জিয়া বিদেশ যাওয়ার সুযোগ পেলে সেসব যোগাযোগের পথ আবার সৃষ্টি হবে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর আরেক সদস্য বলেন, ‘তারেক রহমানের প্রতি দেশ-বিদেশে যে অনাস্থা রয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে খালেদা জিয়া বিদেশ যেতে পারলে তা দূর করার পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হবে। রাজনীতিতে তার অনুপস্থিতির কারণে বিএনপি অনেক দেশের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে পিছিয়ে গেছে। এখন বিদেশ যাওয়ার সুযোগ দিলে সেসব সুবিধা পেয়ে যেতে পারে বিএনপি।’
খালেদা জিয়ার সরকারের সময় জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বিরোধী দলের আন্দোলনের মধ্যে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। ওই সরকারের সময় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি মামলা করা হয়। তারা ছাড়াও দুই দলের বেশ কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে মামলা হয়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। তখন থেকে বিএনপি ক্ষমতার বাইরে। আওয়ামী লীগের আমলেও খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা হয়েছে।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় ১৭ বছর সাজা হয়েছে। ২০১৮ সালে ৮ ফেব্রুয়ারি একটি মামলা সাজা হওয়ার পর তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। ওই বছরের ২৯ অক্টোবর আরেকটি মামলায় তার সাজা হয়।
করোনা মহামারী শুরু হলে ২০২০ সালের ২৫ মার্চ ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারা অনুযায়ী সরকার নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত করে এবং তিনি মুক্তি পান। খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে ডায়াবেটিস, আর্থ্রাইটিস, হৃদরোগ, লিভার সিরোসিসসহ নানা রোগে ভুগছেন বলে তার চিকিৎসকরা জানিয়ে আসছেন।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুবউল আলম হানিফ বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মহানুভবতায় সাজাপ্রাপ্ত একজন আসামির সাজা স্থগিত করে বাসায় থাকার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এর চেয়ে আর কী সুযোগ চায় তারা? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ও সরকারের এখতিয়ারের ভেতরে যা রয়েছে তার চেয়ে বেশি সুবিধা খালেদা জিয়াকে দেওয়া হচ্ছে।’