আনুষ্ঠানিকভাবে ভেঙে গেল জাতীয় পার্টি। গতকাল রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিশনে রওশন এরশাদপন্থিরা কাউন্সিল করে নতুন কমিটি ঘোষণা দিয়েছেন। এতে ৩ বছরের জন্য এরশাদপত্নী বেগম রওশন এরশাদ চেয়ারম্যান এবং কাজী মামুনুর রশীদ মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন। জাতীয় পার্টি ব্রাকেটবন্দি হলেও এখনো লাঙ্গলের কর্তৃত্ব আরেক অংশের চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের হাতেই আছে। এ ছাড়াও দলীয় কার্যালয়ও আছে জিএম কাদেরপন্থিদের কবজায়। এটি নিয়ে নতুন করে কোনো নাটকীয় পরিবেশ সৃষ্টি হয় কিনা এখন তা দেখার বিষয়। কাউন্সিলে রওশন এরশাদপন্থিরা দলকে নতুন করে সাজিয়ে শক্তিশালী অবস্থায় নিয়ে যেতে চান বলে জানিয়েছেন। জিএম কাদেরের নেতৃত্বাধীন অংশের মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু এক প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছেন, আমরাই মূল জাতীয় পার্টি। যদিও জাতীয় পার্টির ভাঙনের ইতিহাস এটাই প্রথম নয়। এর আগেও ৬ বার ভেঙেছিল দলটি।
তার নাম চেয়ারম্যান হিসেবে ঘোষণা করা হলে উপস্থিত কাউন্সিলর ও ডেলিগেটরা দুহাত তুলে সমর্থন জানান। মহাসচিব হিসেবে ঘোষণা করা হয় কাজী মামুনুর রশীদের নাম। এরপর তিনি রওশনের পা ছুঁয়ে সালাম করেন। আংশিক কমিটিতে আরও দায়িত্ব পান নির্বাহী চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ, সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, কো-চেয়ারম্যান সাহিদুর রহমান টেপা, শফিকুল ইসলাম সেন্টু, রাহগির আল মাহি সাদ এরশাদ, গোলাম সারোয়ার মিলন ও সুনীল শুভ রায়। এর আগে ২৮শে জানুয়ারি রওশন এরশাদ নিজেকে চেয়ারম্যান ও কাজী মামুনুর রশীদকে মহাসচিব ঘোষণা দিয়ে পার্টি চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নুকে বহিষ্কার করেন। এরপর বহিষ্কৃত ও স্বেচ্ছায় দল থেকে সরে আসা নেতাকর্মীদের একাট্টা করেন রওশন।
সৈয়দ আবু হোসেন বাবলার সভাপতিত্বে কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। দুপুর ১২টায় কাউন্সিলের শুরুতে জাতীয় সংগীত এবং দলীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। এরপর শোক প্রস্তাব পাঠ করেন দলটির ভাইস চেয়ারম্যান জিয়াউল হক মৃধা। রওশন এরশাদ সভাস্থলে যোগ দেন বেলা ১২টা ৪০ মিনিটে। এ সময় কণ্ঠশিল্পী নকুল কুমার বিশ্বাস গান পরিবেশন করে তাকে স্বাগত জানান।
কাউন্সিলে সাংগঠনিক রিপোর্ট পেশ করেন খণ্ডকালীন মহাসচিবের দায়িত্বে থাকা কাজী মামুনুর রশীদ। এ সময় রওশন এরশাদ লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন। তিনি বলেন, এই সম্মেলন যদি না হতো, তাহলে জাতীয় পার্টি হারিয়ে যেতো। হাজার হাজার নেতাকর্মীকে আমরা হারিয়ে ফেলতাম। দেশের মানুষ জাতীয় পার্টি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতো। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেই তার প্রতিফলন ঘটেছে। এই দশম সম্মেলনের মাধ্যমে এরশাদের নীতি-আদর্শ এবং উন্নয়ন-সমৃদ্ধি ও সংস্কারের রাজনীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। জনগণের মনে আবার আমরা বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি।
তিনি বলেন, আমরা অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করে এখনো টিকে আছি। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের পর যখন একটু ঘুরে দাঁড়ালাম, তখন আমাদের দলীয় প্রতীক লাঙ্গল নিজেদের আয়ত্তে রাখার জন্য আদালতে দাঁড়াতে হয়েছিল। আদালতের সুবিচারে এরশাদ এবং আমি লাঙ্গল প্রতীক জাতীয় পার্টির জন্য বরাদ্দ পেয়েছিলাম। সেই লাঙ্গল প্রতীক এখনো আমাদের জাতীয় পার্টির অনুকূলে আছে এবং আগামীতেও থাকবে।
রওশন বলেন, স্পষ্টভাবে বলে দিতে চাই- এরশাদের জাতীয় পার্টিতে কোনো বিভেদ নেই। আমরা এক আছি, ঐক্যবদ্ধ আছি এবং থাকবো। অতীতে যারা পার্টি ছেড়ে গেছে, তারা কেউ এরশাদের নীতি-আদর্শ নিয়ে যায়নি। এমনকি তারা তার ছবিও সঙ্গে নেয়নি। তাই জাতীয় পার্টি কখনো ভেঙেছে- তা আমি মনে করি না। পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে আমি পার্টির ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত না রেখে বিকেন্দ্রীকরণ করার প্রস্তাব রেখেছি। জাতীয় পার্টিতে গণতন্ত্র চর্চার একটা নিদর্শন আমরা সৃষ্টি করতে চাই।
সম্মেলনে এরশাদপুত্র রাহগির আল মাহি সাদ এরশাদ বলেন, আমার আব্বুর রেখে যাওয়া তার প্রিয় সংগঠন জাতীয় পার্টিকে আবার সুসংগঠিত করার অঙ্গীকার নিয়ে আপনাদের সামনে দাঁড়াতে পেরেছি। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার করণে- শিশু বয়সেই মায়ের হাত ধরে আমাকে জেলে যেতে হয়েছিল। আজ আবার রাজনীতির জন্যে মায়ের হাত ধরে আপনাদের সামনে এসেছি।
মহাসচিব কাজী মামুনুর রশীদ বলেন, আয়-ব্যয়ের হিসাব চেয়ে একাধিক দফায় চিঠি দিলেও সাবেক কমিটির চেয়ারম্যান ও মহাসচিব (জিএম কাদের ও মুজিবুল হক চুন্নু) কোনো উত্তর দেননি। যে কারণে কোনো হিসাব উপস্থাপন করা সম্ভব হয়নি। এখন হিসাব না দিলেও ভবিষ্যতে আইনগতভাবে হিসাব আদায় করা হবে। জিএম কাদের পার্টির সঙ্গে বেঈমানি করেছেন।
তিনি বলেন, ২৬টি আসনে সমঝোতার মাধ্যমে নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতির প্রার্থী হিসেবে রংপুর-৩ আসনে প্রার্থী হন। জিএম কাদের জাতীয় পার্টির প্রার্থী ছিলেন না। তিনি বারবার বলেছেন, নির্বাচনে অংশ নেবেন না। সারা দেশের ২৫০ জন প্রার্থীকে কোরবানি দিয়েছেন। তাদের কোনো খোঁজ নেননি। আমরা জাতীয় পার্টিকে শক্তিশালী দল হিসেবে গড়ে তুলবো।
সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন কৃষক-শ্রমিক-জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, জেপি’র মহাসচিব সাবেক মন্ত্রী শেখ শহীদুল ইসলাম, বাংলাদেশ লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (বিএলডিপি) চেয়ারম্যান সাবেক মন্ত্রী এম নাজিমউদ্দীন আল-আজাদ, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের এমএ মতিন প্রমুখ। এ ছাড়াও যোগ দেন চীনের সহকারী রাষ্ট্রদূত ফেং জিজিয়া প্রমুখ।
বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বলেন, আমি স্বৈরাচারকে ঘৃণা করি। এরশাদ যখন স্বৈরাচার ছিলেন তখন তাকেও তীব্র ঘৃণা করতাম। তিনি প্রেসিডেন্ট থাকতে তাকে ঘৃণা করতাম। আমার হৃদয়ে স্বৈরাচারের কোনো জায়গা নেই। তবে তিনি স্বৈরাচার থেকে একজন প্রকৃত রাজনীতিবিদ হয়েছেন এজন্য তিনি এই উপমহাদেশের একজন শ্রেষ্ট মানুষ।
কাউন্সিলের বিষয়ে জাতীয় পার্টির একাংশের মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, আরেকটি ব্রাকেটবন্দি দল হতে পারে। কিন্তু আমরাই মূল জাতীয় পার্টি। রওশন এরশাদপন্থিদের পৃথক কাউন্সিল করা দলের গঠনতন্ত্র বিরোধী। তবে আমরা তাদের কার্যক্রমকে গুরুত্ব দিচ্ছি না। জিএম কাদেরের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি ঐক্যবদ্ধ রয়েছে এবং থাকবে।